পৃথিবীতে এমন অনেক মানুষ আছেন, যাঁরা জীবনকালে এমন কিছু করে যান, যার জন্য তাঁরা দুনিয়ার মায়া চিরতরে ত্যাগ করে চলে যাওয়ার পরও বেঁচে থাকা মানুষেরা তাঁদের মনে রাখেন, স্মরণ করেন। বাংলাদেশের সাহিত্যিক-সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী তেমন একজন মানুষ। ৮৮ বছরের জীবন পেয়েছিলেন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। এর মধ্যে প্রায় ৭২ বছরই সাংবাদিক হিসেবে লেখালেখিতে সক্রিয় ছিলেন। এতগুলো বছর ধরে কত রাজনৈতিক কলাম লিখেছেন, সেই হিসাব সম্ভবত তাঁর নিজের কাছেও ছিল না। দুই হাতে লেখা বলে একটি কথা আছে। কথাটা আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর ক্ষেত্রে যেন শতভাগ সত্য। তিনি যেন দুই হাতেই লিখতেন। মাত্র ১৬ বছর বয়সে ছাত্র অবস্থায় ‘দৈনিক ইনসান’ পত্রিকার সাংবাদিক হিসেবে যে জীবনের শুরু, তার সমাপ্তি ঘটেছে ২০২২ সালের ১৯ মে, নিজের দেশ থেকে বহু দূরে সুদূর লন্ডনের একটি হাসপাতালে। তিনি জীবনভর যত যা লিখেছেন তার সবগুলোর জন্য না হলেও মাত্র একটি গীতিকবিতার জন্য তাঁকে বাঙালি জাতি চিরদিন মনে রাখবে, স্মরণ করবে। বলবে, গাফ্ফার চৌধুরী, আমরা কি আপনাকে ‘ভুলিতে পারি’?
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষার বীরত্বপূর্ণ আন্দোলন স্তব্ধ করার জন্য তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী চরম নিষ্ঠুরতার আশ্রয় নিয়ে গুলিবর্ষণ করেছিল। শহীদ হয়েছিলেন বরকত, রফিক, জব্বারসহ বেশ কয়েকজন। গাফ্ফার চৌধুরী মাথার খুলি উড়ে যাওয়া এক শহীদের রক্তাক্ত শরীর দেখেছিলেন। ঢাকা কলেজের ছাত্র ১৮ বছরের এক তরুণ গাফ্ফার চৌধুরীর হৃদয়ে তখন যে রক্তক্ষরণ শুরু হয়, তাই তাঁকে রচনা করতে প্রাণিত করে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি?’ অতিসাধারণ সব শব্দ দিয়ে গাঁথা এই মালা কেন বাঙালির কণ্ঠে মণিহার হলো? কারণ এতে ধ্বনিত হয়েছে বাঙালির মনের কথা। প্রথমে আব্দুল লতিফ, পরে শহীদ আলতাফ মাহমুদ সুর দিয়ে এই শব্দগুলোকে করে তুলেছেন এমন এক গান, যা বাঙালির জন্য যেকোনো সংকটে, সংগ্রামে উত্তরণের অভয়বাণী হয়ে উঠেছে। তাই কালজয়ী সৃষ্টির জন্য গাফ্ফার চৌধুরীকে ভুলে যাওয়া বাঙালির পক্ষে অসম্ভব।
১৯৩৪ সালের ১২ ডিসেম্বর বরিশাল জেলার মেহেন্দীগঞ্জের উলানিয়া চৌধুরী বাড়িতে জন্ম আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর। একেবারে স্কুলজীবনেই রাজনীতির প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। একটি বামপন্থী দলের সঙ্গে জড়িতও হয়েছিলেন। কিন্তু সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী না হয়ে হয়ে উঠেছেন রাজনীতি পরিচালনার মন্ত্রগুরু, পরামর্শক এবং সেটা রাজনীতি সম্পর্কে বিশ্লেষণমূলক কলাম লিখে।
ফ্ফার চৌধুরী সাহিত্যিক হতে চেয়েছিলেন। বেশ কয়েকটি উপন্যাসও লিখেছেন। তাঁর প্রথম গ্রন্থ ডানপিটে শওকত। এরপর একে একে লিখেছেন কৃষ্ণপক্ষ, সম্রাটের ছবি, চন্দ্রদ্বীপের উপাখ্যান, সুন্দর হে সুন্দর, নাম না জানা ভোর, নীল যমুনা, শেষ রজনীর চাঁদ ইত্যাদি।
গাফ্ফার চৌধুরী রাজনৈতিক লেখালেখির প্রতি বেশি মনোযোগী বা আগ্রহী হওয়ায় সাহিত্যের পথে হাঁটা কমিয়ে দিয়ে ভালো করেছেন না খারাপ করেছেন, সেটা অন্য বিতর্ক। কিন্তু বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ সব ঘটনার সঙ্গে তিনি নিজেকে যেভাবে জড়িয়েছেন, তা সবার পক্ষে সম্ভব নয়। ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে ছিলেন। কলমযোদ্ধা ছিলেন আইয়ুব-ইয়াহিয়ার সামরিক স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও বন্দুক হাতে না নিয়ে তিনি ছিলেন বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইয়ের সম্মুখযোদ্ধা। তাঁকে বলা হয় কালের সাক্ষী। তিনি শুধু ঘটনার নীরব দর্শক ছিলেন না, ঘটনার মোড় পরিবর্তনের জন্য চালিয়েছেন কলমযুদ্ধ। তিনি যেমন অনেক কিছু কাছ থেকে দেখেছেন, তেমনি সেগুলো লিখেছেনও।