সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন সংস্থা। প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ারভুক্ত কর্মযজ্ঞের চৌহদ্দিও নির্ধারিত। ক্ষেত্রবিশেষে নানামুখী সমন্বয়সাধনের মাধ্যমে কর্মকৌশলের বাস্তবায়ন হয়ে থাকে। বাজেট, রিজার্ভ, ব্যাংক-বিমাসহ আর্থিক খাতগুলোর দেখভাল করে থাকে অর্থ মন্ত্রণালয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রয়েছে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, পুলিশ-র্যাব-বিজিবির সমন্বয়ে সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্ব। একইভাবে প্রত্যেক মন্ত্রণালয় স্ব স্ব দায়িত্ব পালনে কতটুকু গণমুখী তা পর্যালোচনার দাবি রাখে। অভিযোগ আছে, এদের কার্যক্রম অধিকাংশ ক্ষেত্রে জনদুর্ভোগ তৈরি করে থাকে। সংবিধান ও প্রচলিত রীতিনীতি অনুসারে জনগণই সব ক্ষমতার উৎস। সরকারি সেবাপ্রাপ্তিতে সব নাগরিকের অধিকার সমান। সেবাদাতা সরকারি সংস্থাগুলো থেকে নাগরিকদের সেবা গ্রহণে হয়রানি কাম্য নয়। রাজনীতিকদের সভা-সমাবেশে তাদের আলোচনা-বক্তৃতায় জনগণের বিষয়গুলো জোরালোভাবে উপস্থাপিত হয়। কিন্তু বাস্তবে এর পর্যাপ্ত প্রতিফলন দৃশ্যমান নয়। কার্যত সংস্থাগুলোর কার্যক্রমের বাস্তবায়ন কতটুকু জনকল্যাণকর তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। প্রায় সব ক্ষেত্রে ঘুস-দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ শোনা যায়।
ক্ষমতা ও অর্থের দুর্বৃত্তায়ন এবং সুশাসনের অভাব দেশের উন্নয়ন-সমৃদ্ধির প্রতি বড় চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। সততা-যোগ্যতার অবমূল্যায়ন, মিথ্যা-ভিত্তিহীন অভিযোগে শতভাগ নির্দোষ ব্যক্তির বিরুদ্ধে তদন্ত-বিচারের নামে হয়রানি, নিরীহ-দরিদ্র-অসহায় ব্যক্তিদের ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করা ইত্যাদি পুরো দেশকে যেন অস্থিতিশীল করে তুলছে। অর্থলিপ্সুদের বিভিন্ন আর্থিক লেনদেনে প্রতিহিংসা-প্রতিশোধপরায়ণতা প্রকাশ পাচ্ছে। সভ্য মানুষ অযথা সম্মানহানির ভয়ে ক্ষমতা, অর্থ ও পেশিশক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করে নগদ অর্থ-ভূসম্পত্তি খোয়াচ্ছে। প্রকৃত অপরাধীদের মনোরঞ্জন করতে ব্যর্থ হলে ভিটেবাড়িসহ সর্বস্ব হারানোর ভীতি সমাজে নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কথিত বিভিন্ন সংস্থা কর্তৃক প্রতারণামূলক বানোয়াট অভিযোগ তোলা হয়। সম্মানিত ব্যক্তিদের সমাজে হেয়প্রতিপন্ন করার মানসিকতাসম্পন্ন লোকের অভাব নেই। কদর্য চরিত্রের মানুষেরা ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থে নানা উপায়ে অর্থের বিনিময়ে মিথ্যা অভিযোগ তুলছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এসব সংকট উত্তরণে ন্যূনতম মনোযোগ আছে বলে মনে হয় না।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে হয়রানি দরিদ্র-নিরীহ-সহজসরল মানুষকে প্রায় নিঃস্ব করে দিচ্ছে। অন্যদিকে বিত্তশালীদের জন্য অবৈধ উপার্জনের নানা সুবিধার পথ অবারিত। সেতু-কালভার্ট-এক্সপ্রেসওয়েসহ প্রায় সব অবকাঠামোই কিছুসংখ্যক ব্যক্তির উপকারে আসে। সামগ্রিক কল্যাণে এসবের ভূমিকা খুবই সীমিত। সম্প্রতি রাজস্ব আয়ের বিষয়টি ব্যাপক আলোচনার সূত্রপাত ঘটিয়েছে। ২১০ কোটি টাকা দিয়ে দুশ গাড়ি কেনার যে প্রস্তাব জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে দেওয়া হয়েছে, তার যৌক্তিকতা নিয়েও মানুষ বিভ্রান্ত। কর আদায়ে এনবিআর যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে, এটিই স্বাভাবিক। রাজস্ব আয়ের ওপর দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড অনেকটাই নির্ভরশীল। কিন্তু কর আদায়ের ক্ষেত্রে কিছু বড় শিল্পপতি-ব্যবসায়ীকে আড়ালে রাখার অপকৌশল দুঃখজনক। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এবং স্বল্প আয়ের মানুষ, নিম্নমধ্যবিত্ত বা দরিদ্র চাকরিজীবীদের কর কাঠামোর আওতায় আনা দেশের স্বার্থেই প্রয়োজন। কিন্তু বিশেষ উপার্জন না থাকলে আয়বৈষম্যের বিবেচনায় এদের হয়রানিমুক্ত রাখা একান্ত জরুরি। অডিটের নামে করদাতাদের বারবার ডাকা হচ্ছে। নোটিশ পেয়ে অফিসে গিয়ে ধনসম্পদের ব্যাখ্যা দিতে দিতে অনেক ক্ষেত্রে করদাতাদের হয়রানির শিকার হওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
গত ২৮ এপ্রিল গণমাধ্যমে প্রকাশিত এনবিআরের তথ্যানুসারে, চলতি অর্থবছরে আয়কর আদায় হবে ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্তপূরণে আগামী অর্থবছরে প্রয়োজন ১ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ আদায় বাড়াতে হবে ৪৩ হাজার কোটি টাকা। সংস্থাটির দাবি, লোকবল নিয়োগ-লজিস্টিক সাপোর্ট এবং এ খাতে নজরদারি বাড়ানো গেলে পূরণ হবে রাজস্বের বড় চাহিদা। বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব উদ্যোগের পাশাপাশি কর ফাঁকি রোধ এবং করের নতুন নতুন ক্ষেত্র আবিষ্কারে মনোযোগ দিতে হবে। উৎসে কর আদায়ের জায়গাটি যদি আরও শক্তিশালী এবং বিশ্লেষণ করে ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো চিহ্নি করা যায়, তাহলে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব। একই সঙ্গে কর ফাঁকির দিকেও নজর দিতে হবে। দেশে কর আদায়ের প্রধান তিনটি খাত হলো-আয়কর, মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ও আমদানি-রপ্তানি শুল্ক। এনবিআরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ফ্রেইট ফরওয়ার্ড এজেন্সি, শিপিং এজেন্সি, বিদেশি প্রতিষ্ঠান, ইটভাটা, ট্রাভেল এজেন্ট, কনসালটেন্সি সার্ভিস, ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে হাউস, প্রপার্টি, জনশক্তি রপ্তানি, আবাসন ইত্যাদি খাতে ব্যাপক কর ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে।