বনজংলার সঙ্গে ঐতিহাসিকভাবেই এই জনপদের এক গভীর গোপন সম্পর্ক আছে। মৈতৈ মণিপুরী, মান্দি কি বাঙালি জাতির ভেতর প্রচলিত মহাকাব্যসমূহ অরণ্যজীবন তাড়িত। মহাভারতে আছে, দেবতা অগ্নির অরুচি ও ক্ষুধামান্দ্য হলে খাণ্ডববন আগুনবাণ মেরে পুড়িয়ে দেয়া হয়। অগ্নিকে বনপোড়া প্রাণীর মাংস খাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়। বনপোড়া মাংস খেয়ে অগ্নির ওই রোগ সারে বলে অরুচি ও ক্ষুধামান্দ্য ‘অগ্নিমান্দ্য’ হিসেবেও পরিচিত। এক ময়দানব ছাড়া আর কেউ বেঁচে থাকে না ওই বনের। মহাভারতের কাল শেষ হয়ে গেলেও আমরা দেখি এখনও বাজার কি বনবিভাগের ক্ষুধামান্দ্য শেষ হয়ে যায়নি। আর তাই একটির পর একটি মুমূর্ষু শীর্ণকায় বনের টুকরোও আর আস্ত রাখে না কেউ। নির্বিচারে অরণ্যভূমি দখল, বিক্রি, নিশ্চিহ্ন ও লুট হয়ে যায়। সুন্দরবনসহ উপকূলীয় বনভূমি, পার্বত্য চট্টগ্রামের বনাঞ্চল, সিলেট অঞ্চলের বর্ষারণ্য, মধুপুর-ভাওয়াল ও উত্তরবঙ্গের শালবন, বৃহত্তর ময়মনসিংহের সীমান্ত টিলার বনভূমি, বরেন্দ্রভূমির গ্রামীণবন, হাওরের জলাবন ঘিরে এখনও দেশের ৬০ কি তারও কমবেশি আদিবাসী ও পেশাগত মৌয়াল-বাওয়ালী-চুনারি-মাঝি-জেলে জনগণের বসবাস। আদিবাসী ও পেশাগত বননির্ভর জনগোষ্ঠীসহ প্রায় ৩৫ লাখ মানুষ এখনও কোনো না কোনোভাবে দেশের প্রাকৃতিক বনভূমির উপর নির্ভরশীল। নিম্নবর্গের এই ঐতিহাসিক বননির্ভরশীলতা এখনো রাষ্ট্রীয় নীতি কি নথিতে স্বীকৃত হয়নি। প্রাকৃতিক বন ছাড়া সভ্যতা টিকে থাকে না। অপরদিকে বননির্ভর জনগণ ছাড়া প্রাকৃতিক বনের বিস্তারও রুদ্ধ হয়। দেশে বিদ্যমান ক্ষয়িষ্ণু প্রাকৃতিক বনভূমির কোনো কোনো নির্দিষ্ট অংশকে জাতীয় উদ্যান, অভয়ারণ্য, গেম রিজার্ভ, রক্ষিত বন, সংরক্ষিত বন নাম দেয়া হয়েছে। আবার একইসাথে প্রাকৃতিক বনভূমিতেই প্রশ্নহীনভাবে গড়ে তোলা হয়েছে নানান সামরিক-বেসামরিক স্থাপনা, খনন, কারখানা, বাণিজ্যিক পর্যটন ও বৃহৎ প্রকল্প।
‘জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২’ অনুযায়ী দেশে আদিবাসী জনসংখ্যা দেখানো হয়েছে ১৬,৫০,১৫৯ জন এবং জাতিসত্তা ৫০টি। দেশে আদিবাসী জনসংখ্যা মোট জনসংখ্যার মাত্র ১.২ ভাগ। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট পরিচালিত ২০১৮ সালে শেষে হওয়া ভাষাগত জরিপের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে আদিবাসীদের ৪০টি মাতৃভাষা আছে। এর ভেতর কন্দ, খাড়িয়া, কোডা, সৌরা, মুন্ডারি, কোল, মালতো, খুমি, পাংখোয়া, রেংমিটচা, চাক, খিয়াং, লুসাই ও লালেং এই ১৪টি আদিবাসী মাতৃভাষা বিপন্ন। আদিবাসী জাতির জীবনধারায় প্রাকৃতিক বনভূমি অবিচ্ছিন্নভাবে জড়িয়ে আছে। অনেক আদিবাসী নাগরিক নিজেদের বনভূমির সন্তান মনে করেন। আদিবাসী জনগণ বনবাস্তুসংস্থানের অংশ। আদিবাসী জনগণ নিজেদের বনের নিয়ন্ত্রক বা শাসক মনে করেন না, মনে করেন এর ব্যবস্থাপক। বনকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে আদিবাসী মনোজগত, নিজস্ব পরিসর, রীতি, আচার, কৃত্য, ধর্ম, আপন সত্তা ও বৈভব, সাহিত্য, লোকায়ত জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প ও সংস্কৃতি। আদিবাসী জনগণ এবং বনভূমি অভিন্ন যমজ। এদের জোর করে আলাদা করা যায় কিন্তু আলাদা করলে এরা কেউ আলাদাভাবে স্বকীয় সত্তা নিয়ে বাঁচতে পারে না।
প্রায় সকল আদিবাসী জাতিরই রয়েছে নিজস্ব লোকায়ত বনবিজ্ঞান ও বনপ্রতিবেশীয় অভিজ্ঞতা। আদিবাসীদের পবিত্র বৃক্ষ, পবিত্র প্রাণবৈচিত্র্য, পবিত্র বনভূমি ও পবিত্র জলাভূমি সংরক্ষণ চর্চার ধারা আছে। খাদ্য, পানীয়, চিকিৎসা, কৃত্য, আচার, পার্বণ, গৃহস্থালীসহ দৈনন্দিন জীবন অনেকটাই বনের উপর নির্ভরশীল। আদিবাসী জনগণ বনকে ব্যক্তিগত সম্পত্তি মনে করেন না। বনকে কেনাবেচা করা যায় এমন বাণিজ্যিক পণ্য মনে করেন না। বনভূমিকে কেবলমাত্র বাণিজ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার বিবেচনা করেন না। খাদ্য ও জীবনের নিরাপত্তার জন্য আদিবাসীসহ স্থানীয় মানুষ বনের উপর নির্ভরশীল হলেও ইউরোপীয় রেকর্ড থেকে বনভূমি বাণিজ্যিকায়নের এক দুর্ধর্ষ কীর্তি জানা যায়। ১৭৭৮ সালে ক্যাপ্টেন জেমস কুক তার বাণিজ্য জাহাজ মেরামত করাতেন উত্তর-পশ্চিম আমেরিকার নুটকা সাউন্ড অঞ্চলে। জাহাজ মেরামতের জন্য তখন বনভূমির বৃক্ষের কাঠ ব্যবহৃত হতে থাকে। পরবর্তীতে ভ্যানকুভার দ্বীপ থেকে কাঠের তৈরি জাহাজের স্পার চীনে বিক্রি করাই এক লাভজনক ব্যবসা হয়ে দাঁড়ায়। এটি ১৮০০ শতক পর্যন্ত বনভূমিকেন্দ্রিক এক প্রধান বাণিজ্যে পরিণত হয়। পরবর্তীতে কেবলমাত্র জাহাজ নয় উপনিবেশিক শাসকদের দুর্গও তৈরি হতে থাকে কাঠ দিয়ে। বাড়তে থাকে কাঠের বাণিজ্য এবং বনের বাণিজ্যিকায়ণ। এই বাণিজ্য চাঙ্গা রাখতেই এশীয় অঞ্চলের বনভূমির উপর তৈরি হয় ব্রিটিশ উপনিবেশিক নিয়ন্ত্রণ। অরণ্যের গিলা-কলিজা তছনছ করে শুরু হয় এক প্রশ্নহীন উপনিবেশিক বন-বাণিজ্য।