ভাষা নিয়ে আবেগ ও আত্মজিজ্ঞাসা

আজকের পত্রিকা মোনায়েম সরকার প্রকাশিত: ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১১:১২

১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করতে গিয়ে বাঙালি যে গৌরবের সমাচার তৈরি করেছে, তা তুলনাহীন। ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই বাঙালি হেঁটেছে স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এ দেশের মানুষ নবীন রাষ্ট্রকে উন্নত করতে ছিল ঐক্যবদ্ধ। কিন্তু ভাষার প্রশ্নে তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলা ভাষাভাষী মানুষকে আস্থায় না নিয়ে, বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে রাজি না হয়ে এককভাবে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিয়ে বাঙালিদের বিক্ষুব্ধ করে তুলল।


পাকিস্তানের মোহাজের এবং পাঞ্জাবি সিভিল ও মিলিটারি চক্র প্রকৃতপক্ষে গণতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিল না। তারা বাঙালিদের সঙ্গে সব সময় অস্ত্রের ভাষায় কথা বলত। তাদের একটি বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে বাঙালি ভিতু জাতি, তাদের ভয়ভীতির মাধ্যমে দমিয়ে রেখে নিরন্তর শোষণ করেই পাকিস্তানের সমৃদ্ধি আনা সম্ভব। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানকে তারা উপনিবেশ হিসেবেই গণ্য করত।


তখন পাকিস্তানের উল্লেখযোগ্য রপ্তানি পণ্য ছিল পাট। আর এই পাট পূর্ব পাকিস্তানেই চাষ হতো। এই পাট রপ্তানির টাকায় পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়ন পরিচালিত হতো। চক্ষুলজ্জা বিসর্জন দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের উন্নয়নের জন্য ছিটেফোঁটা বরাদ্দ দেওয়া হতো। এই কাজে তারা এ দেশে কিছু দালাল সৃষ্টি করে তাদের দিয়েই শাসন-শোষণ পরিচালনা করত। প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তান ছিল একটি কৃত্রিম রাষ্ট্র। দুই প্রদেশের মধ্যে হাজার মাইলের ব্যবধান ছিল। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী অনেক সময় মজা করে বলতেন, ‘আসলে মুসলমান-মুসলমান ভাই-ভাই—এই স্লোগান ছাড়া পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সেতুবন্ধের আর কোনো বন্ধন ছিল না। তবু বাঙালিরা এই পাকিস্তান মেনে নিয়েছিল। এমনকি পাকিস্তান ইস্যুতে গণভোটে পাকিস্তানের পক্ষে এই অংশের মানুষ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট দিয়েছিল। কিন্তু স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে, ভাষার প্রশ্নে পাঞ্জাবি শাসকগোষ্ঠীর একগুঁয়ে মনোভাব বাঙালিকে বাধ্য করেছে স্বতন্ত্র রাষ্ট্রচিন্তার দিকে ঠেলে দিতে। তারা বুঝতে পারেনি ভাষার প্রশ্নেই কৃত্রিম রাষ্ট্রটি ভেঙে পড়বে। ফলে ’৫২-র ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্র-জনতার মিছিলে তারা গুলি চালানোর মতো হঠকারী সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিল। ভাষার দাবিটি যে বাঙালি জাতির জন্য কত গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ আরও অনেকের জীবনদান সমগ্র বাঙালি জাতিকে উদ্বেলিত করে এমনভাবে ঐক্যবদ্ধ করেছিল, যা ইতিহাসে বিরল ঘটনা। আমরা পরবর্তী সময়ে অনেক মৃত্যু দেখেছি; কিন্তু সমগ্র জাতির মধ্যে এমন গণজাগরণ আর দেখা যায়নি। একুশের শহীদদের আত্মদান বাঙালি জাতিকে রাষ্ট্রভাষা, স্বাধীনতা এবং বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার স্বীকৃতি এনে দিয়েছে। কাজেই এই মৃত্যু গৌরবের ও মর্যাদার।


যে রেসকোর্স ময়দানে বলদর্পী জিন্নাহ উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করে বিভেদের বীজ রোপণ করেছিলেন, সেই রেসকোর্স ময়দানেই ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু জাতিকে ঐক্যবদ্ধ থেকে যার যা আছে তাই নিয়ে স্বাধীনতাযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়েই বাংলার আপামর জনগণ ৯ মাসের এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে বিশাল পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাস্ত করে ’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর ৯৫ হাজার পাকিস্তানি সৈন্যকে সেই রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করেছিল।


ভাষার প্রশ্নটি প্রথমে বাঙালি জাতির দৃষ্টি আকর্ষণ করেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। কুমিল্লা থেকে নির্বাচিত এই গণপরিষদ সদস্য পাকিস্তান গণপরিষদে আলোচনার ভাষা কী হবে—এই বিতর্কে তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ পাকিস্তানি জনগণের ভাষা বাংলাকে পরিষদের অন্যতম ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি জানাতে পরিষদ সদস্যদের আহ্বান জানান। কিন্তু সেদিন তাঁর আহ্বানে তেমন কেউ সাড়া দেননি।


গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের এই ক্ষীণ কণ্ঠের উচ্চারিত দাবি পরবর্তীকালে সমগ্র বাঙালি জাতির প্রাণের দাবিতে পরিণত হয়েছিল। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা দেখে যেতে পারেননি। ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাঁকে কুমিল্লার বাসা থেকে ধরে নিয়ে ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টে আটক রেখে নির্মম নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করেছে। আমরা আশা করি যত দিন বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশ থাকবে, তত দিন শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নাম ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

সংবাদ সূত্র

News

The Largest News Aggregator
in Bengali Language

Email: [email protected]

Follow us