ছোটবেলায় নিলুফার ছিল আর দশজন শিশুর মতো হাস্যোজ্জ্বল। এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করত। নিলুফারকে চার বছর বয়সে তার মা-বাবা ভর্তি করেন একটি স্কুলে। প্রতিদিন যখন ছোট্ট নিলুফার স্কুলে যেত, তখন মা-বাবার সে কী আনন্দ! কিন্তু এই আনন্দ ফিকে হয়ে ওঠে হঠাৎ করেই। একদিন ছোট্ট নিলুফার ঘুম থেকে উঠে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। ডাক্তাররা পরীক্ষা করে জানান, নিলুফার মাসকুলার ডিসট্রোফি নামের একটি রোগ হয়েছে। যে রোগের ফলে নিলুফার ধীরে ধীরে চলনশক্তি হারিয়ে ফেলে, ছোট হয়ে আসে তার চলাচলের পরিসর। কিন্তু দমে না গিয়ে হুইলচেয়ারে বসেই স্বপ্ন ডানায় আকাশ পাড়ি দিতে চায় নিলুফার।
নিলুফার নিজে নিজেই পড়াশোনা শুরু করে এবং বিভিন্ন জিনিস শিখতে ও জানতে থাকে। একসময় সে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করতে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে চায়, কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অবকাঠামোগত অব্যবস্থাপনা তাকে শেখার কিংবা চলাফেরার স্বাধীনতা দেয় না। নিলুফার বুঝতে পারে, তার শিক্ষকেরাই চান যে সে আলাদা পড়াশোনা করুক, সবার সঙ্গে নয়। এমন বৈষম্যমূলক ব্যবহারের কারণে নিলুফার ভেঙে পড়ে। সে জানে না কার কাছে যাবে তার অভিযোগ নিয়ে। ভাঙা মন নিয়েও পাখা মেলতে চাওয়া নিলুফার প্রতিটি ধাপেই বাধার সম্মুখীন হয়।
শহরের ফুটপাতগুলো নিলুফারের হুইলচেয়ারবান্ধব নয়, যখন-তখন কোথাও যেতে পারে না সে। লোকাল বাসগুলোর দরজা ফুটপাত থেকে উঁচুতে এবং প্রবেশপথ সরু হওয়ার কারণে নিলুফার হুইলচেয়ার নিয়ে বাসে উঠতে পারে না। টেবিল টেনিসে পারদর্শী হওয়া সত্ত্বেও প্রতিবন্ধী হওয়ার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারেনি। কারণ বিশ্ববিদ্যালয় তার জন্য উপযোগী করে প্রতিযোগিতার আয়োজন করেনি।
নিলুফারের মতো আরও অনেক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি আছেন যাদের বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। তেমনি একজন নিলুফারের বন্ধু শামসুল আলম, একজন বাক প্রতিবন্ধী। আলম যখন একটি আইনগত সমস্যায় পড়েন তখন থানায় ইশারা ভাষার সুবিধা না থাকার কারণে তাঁর কথা বুঝিয়ে বলতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হন। থানায় এমন অভিজ্ঞতার কারণে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে আলম বিষয়টি নিয়ে আদালতে পর্যন্ত যেতে চাননি। এত বৈষম্যের সম্মুখীন হওয়ার পরও নিলুফাররা স্বপ্ন দেখেন এক বৈষম্যহীন সমাজের, যেখানে তাঁদের স্বপ্নের ডানা মেলায় কোনো বাধা আসবে না। এই পৃথিবীতে নিলুফার কিংবা অন্য যেকোনো মানুষ অধিকার ও মানব মর্যাদার দিক থেকে সমান এবং সবার অধিকার রয়েছে সমান সুযোগ ও সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার।
নিলুফাররা হয়তো জানেন না যে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের অর্জিত সংবিধান নারী বা শিশুদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা দিয়েছে রাষ্ট্রকে [অনুচ্ছেদ ২৮]। এ ছাড়া সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র বিশেষ ব্যবস্থা নিতে পারে ঐতিহাসিক বা সামাজিকভাবে সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর (যেমন প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী) অনুকূলে [অনুচ্ছেদ ২৮]। যে কারণে রাষ্ট্রের হাতে ক্ষমতা রয়েছে শহরের সব ফুটপাত প্রতিবন্ধীবান্ধব করা কিংবা বাসে ওঠার পথ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য উপযোগীভাবে তৈরি করতে নির্দেশ দেওয়া। কিন্তু বাস্তবতা হলো আমাদের দেশে নিলুফাররা ক্রমাগত অধিকারহীনতা ও বৈষম্যের মাঝে পিষ্ট হচ্ছেন। আমার মতে, এর পেছনে মূল কারণ হিসেবে কাজ করে নিলুফারদের প্রতি সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও পরিবেশগত বাধা।