আমার তখন চিৎকার করে কান্না আসছিল। গা গুলায়ে আসছিল। চোখের সামনে চারটা ময়লা সিমেন্টের ব্যাগে করে চারজন করে মানুষ বহন করা হচ্ছিল। মানুষের শরীর। মৃতদেহ।
এমন নয় যে, আমি কোনো দিন মৃতদেহ দেখিনি বা আগুনে পোড়া মানুষ দেখিনি! রানা প্লাজার বীভৎস হত্যাকাণ্ডের পর গলিত লাশ দেখেছি, হাত-পা কেটে মানুষ বের করতে দেখেছি। লাশ আর এয়ার ফ্রেশনারের যে মিশ্র গন্ধ, তা আজীবনের জন্য মাথায় গেঁথে গেছে অসহ্য এক অভিজ্ঞতা হয়ে।
এমনকি এই চারটা লাশ দেখার আগে প্রায় তিন ঘণ্টা এক অসহনীয় নারকীয় অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হলো।। আগুন, আকুতি, বিলাপ, ভয়, অসহায়ত্ব, বীরত্ব, ভালোবাসা, সহমর্মিতার এক অবর্ণনীয় অভিজ্ঞতা।
শুক্রবার রাতে বাসায় ল্যাপটপের সামনে বসেছিলাম। সে সময় আম্মা ওপরতলা থেকে প্রচণ্ড উৎকণ্ঠা নিয়ে ফোন দিলেন, ‘বাবুরে, ট্রেনে আগুন লাগসে, দাউ দাউ করে জ্বলতেসে।’
বুঝলাম, আমার বাসা থেকে শ খানেক গজ দূরের রেললাইনে ঘটনা ঘটেছে। দৌড়ে গেলাম। কিন্তু মাথায় ছিল না যে যেদিক দিয়ে গিয়েছি সেদিকে দেয়াল দেওয়া।
আগে এই লাইন দিয়ে কেবল নারায়ণগঞ্জের ট্রেন যেত, তবে পদ্মা সেতু হওয়ার পর আরও কিছু ট্রেন যায় শুনছিলাম। লাইন একটার বদলে তিনটা করা হয়েছে। আর রেলের নিরাপত্তার জন্য লাইনগুলোর দুপাশজুড়ে উঁচু করে দেয়াল দেওয়া হয়েছে।
আগুন আর আর্তনাদ শুনতে শুনতে চলে গেলাম বেশ কিছুটা দূরে, পকেটগেট একটা আছে সেখানে। রাস্তায় যেতে যেতে দেখি, সিনেমায় দেখা যুদ্ধের মতো অবস্থা। বেশ কিছু মানুষ উদভ্রান্তের মতো ছুটছেন, হাতে লাগেজ। বাচ্চারা কাঁদছে, বড় বিভ্রান্ত, বিহ্বল। মহল্লার এক বন্ধু দেখি চিৎকার করে কাঁদছে আর বলছে, ‘চোখের সামনে মানুষটা মইরা গেলরে, কিচ্ছু করতে পারলাম না!’ এমনিতে খুব শক্তপোক্ত বলে পরিচিত সেই বন্ধুর কান্নায় টের পাইলাম খারাপ কিছু, খুব খারাপ কিছু। কিন্তু তখন ভাবার সময় নাই।