এ কেমন নৃশংসতা, বর্বরতা? বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন থেকে ছেড়ে আসা মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসের তিনটি বগিতে কারা আগুন জ্বালিয়ে চারজন সাধারণ মানুষকে পুড়িয়ে মারল? আহা! কী পাশবিক ও বর্বরোচিত ঘটনা! এমন নৃশংস ঘটনায় নিমেষেই চারজন জীবন্ত মানুষ আগুনে ঝলসে গেল। নিভে গেল পরিবারের আলো। কোলের সন্তানকে বুকে জড়িয়েই আগুনে পুড়ে ছাই হলেন মা, যা আদিম যুগের বর্বরতাকেও হার মানায়। আহা রে মা! মা বলেই তো কথা। আগুনের ফুলকি, দহন কিংবা ভয়াবহতা মায়ের কোল থেকে সন্তানকে আলগা করতে পারেনি, আলাদা করতে পারেনি। এটাই মানবসভ্যতা, মানবজাতির প্রকৃত রূপ। সভ্য ও প্রকৃতজনেরা বলেন, আহা! এ যে বসুন্ধরা! এই মানবজগতে উল্টো ছবিও আছে। বর্বর ও অসভ্য শ্রেণির কেউ কেউ আছে, যারা কেবল স্বার্থ বোঝে, যাদের ভেতরে মনুষ্যত্ববোধ নেই, নেই দয়ামায়া। ওসব গুণাবলি কখনোই থাকে না মানুষরূপী অমানুষদের। তারা মায়ের কোলে সন্তানের অবস্থান বোঝে না, শিশুর উৎকণ্ঠা বোঝে না, বোঝে না মায়ের অদম্য আবেগ। পুড়ে ছাই হয়ে একজন মা অনেক কথা বলে গেলেন। বুঝিয়ে দিলেন, সভ্যতার আড়ালে এখনো অনেকেই কতটা অসভ্য ও বর্বর। আরও বুঝিয়ে গেলেন, নিরপরাধ হয়েও তিনি অস্থিতিশীল সমাজের চরম বর্বরতা ও নৃশংসতার শিকার। নৃশংসতার মুখোমুখি হয়েও তিনি বুকের সন্তানকে আলগা করেননি। আগুন লাগিয়েও পাষণ্ডরা পারেনি এই বাঁধন ছিন্ন করতে। এ যেন দুর্বৃত্তায়নের প্রতি মায়ের চরম ক্ষোভ ও ঘৃণা এবং তীব্র প্রতিবাদ। এ যেন মায়ের কঠিন লড়াই। যদি ছাইগুলো স্পর্শ করা সম্ভব হয়, তাহলে নিঃসন্দেহে মায়ের সেই আবেগ অনুভূত হবে।
মাত্র কিছুদিন আগে ট্রেনের লাইন কেটে রাখায় একটি ট্রেন দুর্ঘটনাকবলিত হয়েছে। গভীর রাতে নির্জন গ্রামে বেশ কটি বগি লাইনচ্যুত হয়ে দুমড়ে-মুচড়ে যায়। এমন একটি জায়গায় লাইন কেটে রাখায় ঘটনাটি ঘটে, যেখানে খুব দ্রুত উদ্ধারকর্মীরা পৌঁছাতে পারেননি, পারার কথাও নয়। যারা কাজটি করেছে, তারা যাত্রীদের চরম দুর্ভোগ ও প্রাণনাশের পরিকল্পনা করেই করেছে। কী সাংঘাতিক সমাজবিরোধী মানসিকতা! এ কেমন পাশবিকতা! যারা এমন কাজ করছে, তারা কি আদতে বাংলাদেশেরই নাগরিক, বাংলাদেশকে নিজের দেশ ভাবে, নাকি এরা বিচ্ছিন্নতাবাদী কোনো শ্রেণি-গোষ্ঠী? নতুবা এমন বর্বরোচিত মানসিকতা থাকবে কেন তাদের! কেনইবা তারা সাধারণ মানুষকে জিম্মি করছে, সাধারণ মানুষকে টার্গেট করছে! মাঝেসাজে এমন হাজারো আশঙ্কা, সংশয় মনে উঁকি দেয়। যে বা যারা এমন নিকৃষ্ট ও জঘন্য কাজ করছে, সাধারণ মানুষকে জিম্মি করছে, তাদের উদ্দেশ্য যা-ই থাকুক, কাজটি জঘন্য এবং কঠিনতর শাস্তিযোগ্য অপরাধ। রাষ্ট্রবিরোধী বললেও মোটেই ভুল বলা হবে না। এক বাক্যে বলা যায়, রাষ্ট্রের জনগণের বিরুদ্ধাচরণ করে এই সব নৃশংস ঘটনা। কারণ, এসব ট্রেনে সাধারণ জনগণ চলাচল করে। যে জনগণই রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী।
দ্বিমতের কোনো অবকাশ নেই, বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ কতিপয় দুর্বৃত্তর হাতে জিম্মি, আজও অনিরাপদ। এটা বেশি দৃশ্যমান হয়ে ওঠে রাজনৈতিক ইস্যুতে। রাজনীতির চলমান সংস্কৃতিতে জ্বালাও-পোড়াও নিত্যদিনের ঘটনা। আগুন লাগিয়ে দেওয়া, ভাঙচুর করা—এসব রাজনৈতিক কার্যকলাপ বা কর্মসূচি যে সাধারণ জনগণের স্বার্থে নয়, সেটা বুঝতে কারও কষ্ট হয় না। রাজনৈতিক দলগুলো নিজের ক্ষমতা, শক্তি ও আধিপত্য বিস্তারে এমন অরাজকতা চালায়। এর শিকার হয় সাধারণ নিরীহ, নিরপরাধ মানুষ। আবার সাম্প্রদায়িক ইস্যুতে সংখ্যালঘুদের ওপর নৃশংস আক্রমণ চালানো হয়। গণধর্ষণকেও আক্রমণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ধর্মীয় রাজনীতির লেবাসে এমন ঘটনা কম নয়। সত্য হলো, এসব অগ্নিসংযোগে, ভাঙচুরে কখনো কোনো রাজনৈতিক দলের কোনো নেতা, কর্মী বা সমর্থক আগুনে পুড়ে মরেছে, নিঃস্ব হয়েছে কিংবা ধর্ষণের শিকার হয়েছে বলে তেমন একটা জানা যায় না।
তেজগাঁও রেলস্টেশনের মর্মান্তিক ঘটনার কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী বলছেন, বিমানবন্দর স্টেশনে খুব ভোরে নির্দিষ্টসংখ্যক যাত্রী নেমে যাওয়ার পরপরই তিনটি বগিতে আগুন লাগে। ধারণা করা হচ্ছে, যাত্রীবেশে দুর্বৃত্তরা আগে থেকেই ট্রেনে অবস্থান নিয়েছিল এবং বিমানবন্দর স্টেশনে নেমে যাওয়ার পরই এ ঘটনা ঘটে। ধারণা করা হচ্ছে, এটা পরিকল্পিত।
সামনে জাতীয় নির্বাচন। এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতর যে পারস্পরিক পাল্টাপাল্টি অসহনীয় আচরণ, প্রতিশোধপরায়ণতা, নির্বাচনের বিরোধিতা, তেজগাঁও রেল স্টেশনে ট্রেনের অগ্নিসংযোগ যেন এসবেরই সম্মিলিত পরিণতি। দলীয় রাজনীতির সংকীর্ণ স্বার্থে এমন গণবিরোধী ঘটনা অতীতেও ঘটেছে। প্রচলিত রাজনীতির এই ভয়ংকর চেহারা দেখে সাধারণ জনগণ ভীতসন্ত্রস্ত। এমন রাজনীতির প্রতি তাদের কোনো আগ্রহই নেই।