প্রতীক লাভের পর প্রার্থীরা নির্বাচনী মাঠে নেমে পড়েছেন। মোট ১ হাজার ৮৯৬ জন প্রার্থী ৩০০ আসনের জন্য এখন নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় নেমে পড়েছেন। ২৭টি দলের প্রার্থী থাকলেও আওয়ামী লীগ, আওয়ামী লীগ স্বতন্ত্র, জাতীয় পার্টি, তৃণমূল বিএনপি এবং বিএনএমের প্রার্থীর সংখ্যাই বেশি।
বিএনপি এবং আন্দোলনরত দলগুলো নির্বাচন বর্জন ও প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়ে এত দিন হরতাল-অবরোধের ডাক দিয়ে জনগণের মধ্যে তেমন কোনো সাড়া ফেলতে পারেনি। নির্বাচনে যদি বিএনপি ও তাদের জোট অংশ নিত, তাহলে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাঠ সম্পূর্ণ ভিন্ন হতো, নির্বাচনী আবহ প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রূপ লাভ করত, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে না, তা আগে থেকেই স্পষ্ট ছিল। কারণ তাদের দাবি মেনে নেওয়ার অবস্থানে আওয়ামী লীগ নেই, থাকার কথাও নয়। দেশি-বিদেশি সব পক্ষই বিএনপিকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার অনুরোধ করেছিল, কিন্তু তারা বর্তমান সরকারের অধীনে বা সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্তে অটল। তাদের ধারণা সরকার পতনের ‘বন্দোবস্ত’ করতে সক্ষম হবে। সে ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের ওপরেই তাদের বেশি ভরসা ছিল। ২৮ অক্টোবর অনুষ্ঠিত মহাসমাবেশে তাদের নেতা-কর্মীরা রাজধানী ঢাকা শহরে কয়েক দিন অবস্থান নেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েই এসেছিল, কিন্তু হঠকারী কিছু ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার কারণে ওই মহাসমাবেশ তারা শুরুই করতে পারেনি। ফলে সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল, বিএনপির অনেক নেতাই কারাগারে কিংবা আত্মগোপনে চলে গেলেন। হরতাল-অবরোধের ডাক দিয়ে প্রায় ৫০ দিন কাটিয়ে দিল দলটি।
নির্বাচনী তফসিল যথাসময়ে ঘোষিত হলো। তাদের ধারণা ছিল, হরতাল-অবরোধের আন্দোলন চাঙা হলেই তফসিল বাতিল হবে, কিন্তু সেটিও হলো না। নির্বাচনী ট্রেন এখন ৭ জানুয়ারি অভিমুখে যাত্রা শুরু করেছে। বিএনপি যানবাহনে অগ্নিসংযোগ, রেললাইনে নাশকতা সৃষ্টি, অগ্নিসংযোগ বাড়িয়ে দিয়ে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করার কৌশল নিয়েছে। শোনা যাচ্ছে, বিএনপি লন্ডনের ওহি মোতাবেক আগামী কয়েক দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। জনগণকে ভোটকেন্দ্রে না যাওয়ার আবেদন জানিয়ে লিফলেট বিতরণ, উঠান বৈঠক এবং সবশেষে অসহযোগ আন্দোলনের ডাকও দেওয়া হয়েছে। বিএনপির এসব ডাক সাধারণ ভোটাররা কতটা শুনবেন, তা ৭ জানুয়ারি বোঝা যাবে। দেখা গেছে বিএনপির সমর্থকেরাও ঘোষিত কর্মসূচির সঙ্গে একাত্ম হতে পারেন না।
নাশকতার মাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে আগামী কয়েক দিন মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টির কার্যক্রম বাড়ানোর লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। বেশ কয়েকটি রেলে অগ্নিসংযোগ ও ফিশপ্লেট তুলে নেওয়া, ট্রেন লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়া, অগ্নিসংযোগে এ পর্যন্ত পাঁচ যাত্রীর মৃত্যু হওয়ায় ধারণা করা হচ্ছে, রেল চলাচলের ওপর বিঘ্ন সৃষ্টি করার দিকে তারা অধিকতর মনোযোগী। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এসব নাশকতার সঙ্গে জড়িত কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করতে পেরেছে। এর পরও রেলব্যবস্থা বিপর্যস্ত করার জন্য বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মীদের একটি অংশ মরিয়া হয়ে উঠেছে। প্রায় প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও রেল দুর্ঘটনা ঘটানোর গোপন তৎপরতা তারা চালিয়ে যাচ্ছে। নির্বাচন পর্যন্ত তাদের কর্মকাণ্ড কমে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। সে ক্ষেত্রে ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত বিএনপি, জামায়াত এবং যুগপৎ আন্দোলনকারী দলগুলো নির্বাচন ভন্ডুল করতে না পারলেও ভোটার উপস্থিতি হ্রাসের ব্যাপারে যা যা তাদের পক্ষে করণীয়, তার সবই করবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
আগামী কিছুদিনের মধ্যে তাদের কর্মকাণ্ডে আরও হিংস্রতা, নৃশংসতা এমনকি ২০১৩ ও ২০১৫-এর মতো অগ্নিসংযোগ এবং মানুষ হত্যার ঘটনা বাড়িয়ে দিয়ে হলেও তারা তা করতে পারে। গেরিলা কায়দায় সরকারি-বেসরকারি স্থাপনার ওপর তাদের আক্রমণ কিংবা ভয়ভীতি প্রদর্শনের মতো ঘটনা নানা মাত্রিকতায় বাড়তেও পারে। তারা বিষয়টিকে নিজেদের জীবন-মরণ সমস্যা হিসেবে দেখছে। দেশ তাতে জ্বলে-পুড়ে ছারখার হলেও এসব কাজে তারা বিরত থাকবে বলে মনে হয় না। তাদের রাজনীতির আদর্শ ও মানসিকতায় নৃশংসতা, যুক্তিহীনতা ইত্যাদি নিয়ে অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করতে পারেন, কিন্তু নিজেদের অবস্থানে তারা অনড়। তাদের নেতা-কর্মীরা যে বিশ্বাস নিয়ে বড় হয়েছেন, সেই বিশ্বাসের সঙ্গে গণতন্ত্র কতটা যায় কি যায় না; নীতি-নৈতিকতা, মানবতা ইত্যাদি থাকবে কি থাকবে না—তা আশা করেও কোনো লাভ নেই। এই মুহূর্তে জিঘাংসা, প্রতিহিংসা এবং যেকোনো ধরনের নাশকতা ঘটাতে তারা দ্বিধা করবে না।
মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে অগ্নিসংযোগ করে যারা চারজন নিরীহ মানুষকে পুড়িয়ে মেরে ফেলেছে, তারা এর চেয়েও বড় কিছু করতে এখন আর দ্বিধা করবে না। কারণ তারা নিজেদের মতো করে রাষ্ট্রকে চায়, নির্বাচনও চায়। ২৮ অক্টোবর একজন পুলিশকে যে হিংস্রতার সঙ্গে হত্যা করা হয়েছিল, সেই দৃশ্য যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা ভাবতে পারেন না কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মীরা এমন নির্দয়-নিষ্ঠুর আচরণ করতে পারে।