ঢাকা শহরে কোনো এক অদ্ভুত বাসমালিক ছিলেন। তিনি মনে হয় ভবিষ্যৎ দেখতে পেতেন। তাঁর একটা বাসের নাম ছিল জতুগৃহ। জতুগৃহ মানে হলো আগুনের ফাঁদ পাতা ঘর। কৌশলে প্রতিপক্ষকে সেখানে ঢুকিয়ে আগুন লাগিয়ে দিতে পারলেই কেল্লা ফতে। ভাগ্যিস সাড়ে নিরানব্বই ভাগ যাত্রী এর মানে জানতেন না। জানলে উঠতেন না। নিজের কেনা বাসের নাম কেউ জতুগৃহ দেয়? দিতে পারেন, যদি তিনি ভবিষ্যদ্বক্তা হন। হয়তো ওই বাস মালিক বুঝতে পেরেছিলেন, ভবিষ্যতে এমন দিন আসবে যখন যাত্রীবাহী বাস-ট্রেনগুলো জতুগৃহ হয়ে উঠবে। সেসবে ভরসা করে যারা গন্তব্যে যেতে চাইবে, তারা পুড়ে কয়লা হবে।
জতুগৃহ বাসটির ভাগ্যে কী ঘটেছিল আমি জানি না। বহুদিন হলো বাসটিকে আর রাস্তায় দেখি না। হয়তো ২০১৩-১৪ সালের জ্বলন্ত দিনগুলোতেই পুড়ে গেছে ঢাকাই ওই জতুগৃহ। কিন্তু আগাম ইশারাটা ঠিকই দিয়ে গেছে। আমরা বুঝতে পারিনি।
জতুগৃহ হলো মহাভারতের কাহিনির সেই ঘর, যেখানে বনবাসী পাণ্ডবেরা বাঁচার আশায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু আশ্রয়দাতা ছদ্মবেশী বন্ধু। সে আমলে তো পেট্রোল ছিল না। তাই শুকনা লতাপাতা-খড় দিয়ে ঘরটা এমনভাবে সাজিয়ে রাখা হয়েছিল, যাতে সামান্য স্ফুলিঙ্গ থেকে আগুন লেগে সবাই মারা যান। কিন্তু যুধিষ্ঠির সেটা টের পেয়ে আগুন লাগানোর আগেই মা-ভাইদের নিয়ে পালিয়ে বাঁচেন। আমাদের সাধারণ মানুষ বাসে আগুন দেওয়া দেখে ভয়ে যখন ট্রেন বেছে নিলেন, তখন সেটাও হয়ে উঠছে জতুগৃহ।
রাজধানীর একেবারে প্রাণকেন্দ্র তেজগাঁও রেলস্টেশনে যে ট্রেনটা জ্বলতে জ্বলতে এসে থামল, তার চালক বা যাত্রীরা কেউই আগেভাগে কিছু টের পাননি। ফলে মর্মান্তিকভাবে পুড়ে নিহত হলেন চার মানবসন্তান। গা কেঁপে ওঠে, মন শিউরে ওঠে, হৃদয় ধিক্কার দেয় যে দৃশ্যটা দেখে তা ফিলিস্তিনের গাজার কোনো দৃশ্য নয়, এই মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস নামক ট্রেনেরই ঘটনা। পুড়ে অঙ্গার হওয়া দুটি দেহ জড়াজড়ি করে আছে– জীবনেও তারা এমনই ছিল; বাংলার মা ও তার বুকের মানিকেরা যেমন থাকে। বাংলাদেশের সেই মা নাদিরা আক্তার পপি (৩২) কোলের শিশু ইয়াসিনসহই পুড়ে মারা যান। শিশুটা তখনও মায়ের বুক আঁকড়ে ছিল, শিশুটা হয়তো ভরসা খুঁজছিল, শিশুটা হয়তো বাঁচতে চাইছিল, শিশুটা হয়তো বাবাকেও খুঁজছিল… সেই হতভাগা বাবা, কারওয়ান বাজারের সেই দোকানি তখন কাছেই ছিলেন। স্ত্রী-পুত্ররা গ্রাম থেকে ফিরছে, তিনি এসে অপেক্ষা করছিলেন কখন ট্রেন আসবে, কখন সন্তানেরা দৌড়ে আসবে ‘বাবা বাবা’ বলে। তিনি হয়তো ছোটটাকে কোলে তুলে নিতেন, বড়টার মাথায় হাত বোলাতেন আর স্ত্রীকে বলতেন, ‘আসার পথে কোনো কষ্ট হয়নি তো?’
সত্যবাবু যে কোথায় হারালেন?
কখন কোথায় বিস্ফোরণ ঘটবে তা রাষ্ট্রের জানতে এখনও বাকি আছে– ‘হারবার্ট’ নামের উপন্যাসে কথাটা লিখেছিলেন ঔপন্যাসিক নবারুণ ভট্টাচার্য। দেশটা যখন আবারও জতুগৃহ হয়ে উঠছে তখন কে কোথায় কোন হত্যার আয়োজন করে রেখেছে, তা জানাবে কে? বাক্স্বাধীনতার অভাবে মানুষ ভালো করে বলতেও পারছে না যে ‘বাঁচাও’। বলতে পারছে না, ‘মানুষ বড় দুঃখে আছে, মানুষ বড় কাঁদছে, তুমি তার পাশে দাঁড়াও।’