মা-কে কি কেউ ত্যাগ করে? জঙ্গলে ফেলে আসে? করে না। কিন্তু বাংলাদেশে আমরা সেরকম ঘটনাও দেখেছি। তখন করোনা মহামারির কাল। মৃত্যুভয় চারদিকে। এরকম সময়ে, ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে তিন ভাই-বোন মিলে তাদের কভিড-১৯ আক্রান্ত মাকে গাজীপুরের জঙ্গলে ফেলে যায়। কারণ ছিল মৃত্যুভয়, কারণ ছিল চিকিৎসা করাতে না পারার মতো অভাব। মহামারির পরের বাংলাদেশ কি সেরকম ভয়ের জঙ্গলই হয়ে উঠল? না হলে, রাজনীতি কেন তার জননী যে গণতন্ত্র তাকে ত্যাগ করছে বলে মনে হচ্ছে?
বাংলাদেশের জননী হলো গণতন্ত্র। গণতন্ত্রের উদর থেকেই জন্মেছে এই রাষ্ট্র। গণতন্ত্রের দাবিতে বাঙালিরা লড়েছে ’৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে। গণতন্ত্রের দাবিতে গণঅভ্যুত্থান ঘটেছে ১৯৬৯ সালে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষ স্বৈরাচারের বিপক্ষে গণতন্ত্রকে বেছে নিয়েছিল। ফলে নিরঙ্কুশ বিজয় পেয়েছিল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। ওই নির্বাচনের ফলই ঠিক করে দিয়েছিল বাংলাদেশের গন্তব্য হবে গণতন্ত্রের দিকে। পাকিস্তানিরা জনগণের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষাকে স্বীকৃতি দিতে চায়নি বলেই গণতন্ত্রের আন্দোলন স্বাধীনতার আন্দোলনে পরিণত হয়। গণতন্ত্র ছিল ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের বীজ, স্বাধীনতা তার ফল। এই স্বাধীনতার বৈধতাও এসেছিল ওই ১৯৭০ সালের নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা জনগণের ম্যান্ডেট নিয়েই স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। সে কারণে ওই ঘোষণার বৈধতা নিয়ে পাকিস্তান ছাড়া আর কারও জিজ্ঞাসা ছিল না।
নির্বাচন এবং গণতন্ত্র এই দেশের মানুষের রাজনৈতিক সংস্কৃতির খুব গভীরেই প্রতিষ্ঠিত। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনে, ১৯৩৭ সালের নির্বাচনকেও বাঙালিরা অধিকার প্রতিষ্ঠার সুযোগ হিসেবে নিয়েছিল। সেই নির্বাচন তৎকালীন পূর্ব বাংলাকে রাজনৈতিকভাবে জাগিয়ে তুলেছিল। মধ্যবিত্তরা শেরেবাংলা ফজলুল হকের নেতৃত্বে কৃষক-প্রজা পার্টির মঞ্চ থেকে জমিদারদের চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিল। উপমহাদেশের রাজনীতিতে সেটা ছিল বিরাট গণতান্ত্রিক অবদান। কারণ, এই নির্বাচনটি সম্প্রদায়ের চাইতে সেক্যুলার অর্থনৈতিক স্বার্থকে প্রথম সামনে নিয়ে এসেছিল।
বাংলাদেশের মতো এরকম নির্বাচনের সিঁড়ি বেয়ে স্বাধীনতার সংগ্রাম খুব কম দেশেই হয়েছে। এ কারণে নির্বাচন এখানে উৎসব হয়ে উঠেছিল, যে কোনো নিরপেক্ষ নির্বাচনে এখনও এই দেশের ৬০-৭০ শতাংশ ভোটার ভোট দিতে ভোটকেন্দ্রে যায়। গণতান্ত্রিক পরিবেশে তারা ভোটকেন্দ্র পাহারা দেয়, রাত জেগে দেখতে থাকে ভোটের ফল। টিভিতে তখন মধ্যরাতে জনপ্রিয় সিনেমা দেখানোর মধ্যে মধ্যে ফল ঘোষণা হতো–সে কী উৎসাহ!