নদীমাতৃক বাংলাদেশকে বিভিন্ন কারণে অনেকে আগের মতো আর সেভাবে সম্বোধনের ইচ্ছা প্রকাশ করছে না। কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে জনসৃষ্ট তথা প্রাকৃতিক কারণে নদ-নদীগুলোর অকাল মৃত্যু, যা আমাদের কৃষি উৎপাদন ও খাদ্যনিরাপত্তার জন্য এক বড় হুমকি। অথচ একসময় শুধু প্রাকৃতিক নয়, ব্যবসা-বাণিজ্য, জীবন-জীবিকা, নৌযান চলাচল তথা পরিবহনে খাল-বিল, নদী-নালার এক অপূর্ব ভূমিকা ছিল। নদী-নালাগুলো সারা দেশজুড়ে মাকড়সার জালের মতো ছড়িয়ে থাকত যেন পরম করুণাময়ী মায়ের মতো। বাংলাদেশের নদ-নদী কী সাহিত্যে, গানে, নাটকে ও জীবন-জীবিকায় কী অসামান্য অবদান রেখেছে! নৌকাডুবি উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, ‘নদী শুধু নারী নয়, পুরুষের মতো আছে নদ। মানুষের মতো সেও হাসে-কাঁদে, ভাঙে-গড়ে, আছে তার ক্রোধ।’ এ সত্যটা প্রাচীনকাল থেকে উপমহাদেশের সমাজ-সংস্কৃতিতে স্বীকৃত। কেবল তার কোনো আইনি স্বীকৃতি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না।
মানুষের চেয়েও নদ-নদীকে বেশি সম্মান দিয়েছে উপমহাদেশ, বিশেষ করে বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ। সেই আদিকাল থেকে তারা গঙ্গা নদীকে দেবী জ্ঞানে পূজা করে। বিশ্বাস করে, গঙ্গা স্নানে সব পাপ মোচন হয়। লাখ লাখ মানুষ এখনো প্রতি বছর গঙ্গা স্নানে যায়। বিশ্বাস করে, গঙ্গা স্নানে তারা পাপমুক্ত হলো। গঙ্গাকে শুধু দেবত্ব নয়, মায়ের সম্মানও প্রদর্শন করে। কিন্তু উপমহাদেশে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র এসব নদ-নদী দেবতা হিসেবে পূজিত হলেও কখনো তাদের সংরক্ষণ, নিরাপত্তা ও পবিত্রতা রক্ষার চেষ্টা হয়নি। এরপর রবীন্দ্র-পরবর্তী বলয়ে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কালজয়ী গান ‘পদ্মার ঢেউরে’, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’, অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, গোলাম মোস্তফার ‘পদ্মা নদী’, ড. নীহার রঞ্জন গুপ্তের ‘নদীর নামটি মধুমতি’ ভৈরব প্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘রিক্তা নদীর বাঁধ’ আমাদের সাহিত্য অঙ্গনকে সমৃদ্ধ করেছে। নদ-নদী প্রকৃতির দান কিন্তু আমাদের নদীগুলো, যেমন চিত্রা, মধুমতি, নবগঙ্গা, আন্ধার মানিক, পুনর্ভবা, ডাকাতিয়া, বংশাই, সুবর্ণখালী, পেয়াই, শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বরী, নারদ, গড়াই, ধলেশ্বরী, বুড়িগঙ্গা, কর্ণফুলী, মাথাভাঙ্গা, মেঘনা, পদ্মা, যমুনা, পিয়াইন, বাঙালি, মিনাই, সুবর্ণখালী, কালীগঙ্গা, ময়নাকাটা ইত্যাদি ঐতিহ্যের বাহক। কিন্তু এসব ঐতিহ্য এখন বাংলাদেশের শুধু গবেষক কবি কিংবা সাহিত্যিকের সৃষ্টিশীলতার উপাদান। কিন্তু এগুলো এখন এক শ্রেণীর মানুষের অর্থবিত্তের অর্থনৈতিক আকাঙ্ক্ষার কাছে হার মেনে বসেছে যার প্রাদুর্ভাব নদী দখল, নদী দূষণ ইত্যাদি, যা বেশির ভাগ নদীর মৃত্যুর কারণ। বিভিন্ন পত্রিকা দেশের নদ-নদীগুলোর দুর্দশার ওপর ধারাবাহিকতার প্রতিবেদন প্রকাশ করে যাচ্ছে।
এসব প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, নদীবহুল বাংলাদেশ এখন নদীহীন দেশে পরিণত হচ্ছে, বদলে যাচ্ছে জীববৈচিত্র্য, তথা মানুষের জীবন-জীবিকা। এখন অনেক নদী হয়েছে খেলার মাঠ, বসতবাড়ি, চাষের কৃষিজমি কিংবা শিল্প-কারখানার স্থাপনা, আবাসন প্রকল্প, দলীয় স্থাপনা যা হলো সবই অবৈধ। এমন সময় এসে গেছে যে দেশের এ নদীগুলোয় সহজেই বাঁধ দিয়ে চলছে মাছের চাষ, বনায়ন, গরু ও মুরগির খামার। এতে করে দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলীয় কিংবা উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় নদী অর্থনীতি কিংবা হাওর অর্থনীতি এখন বিপাকে পড়েছে। দেশের সমুদ্র উপকূলবর্তী সাতটি জেলার জনপদ সম্পূর্ণভাবে সমুদ্র সংযোগ নদীর ওপর নির্ভরশীল যার মধ্যে আছে নৌকা, নৌযানভিত্তিক ব্যবসা, মৎস্যজীবী শ্রেণীর মাছের আহরণ ইত্যাদি। আবার সমতলে নদী হারিয়ে যাওয়া মানেই দুই পাড়ের মানুষের সভ্যতা বিপন্ন হওয়া। তার মধ্যে গ্রামীণ অর্থনীতির কৃষি ব্যবস্থা, খাদ্য উৎপাদন ও কর্মসংস্থান সবচেয়ে বেশি বিপন্ন। অথচ অনেকেই বলছেন নদী হচ্ছে গ্রাম-বাংলার প্রাণ, যাকে ঘিরে হয় মানুষের জীবনচক্র, বাজার, কল-কারখানা, নানা শিল্পপ্রতিষ্ঠান, শহর, সভ্যতা, তাই নদী হলো জীবন কিংবা নদী হলো মরণ।