প্রথমে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আমাদের একটা নাজুক অবস্থার মধ্যে ফেলেছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ইসরাইল-হামাস সংঘর্ষ। এর ফলে বৈশ্বিক সংকট আরও কত তীব্র হবে কে জানে! পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান ভদ্র ভাষায় বলেছেন, অর্থনীতি চাপের মধ্যে আছে। এখন আমরা অভ্যন্তরীণ সংকটের মধ্যে পড়তে যাচ্ছি। বহিরাগত সমস্যার সমাধান দিতে দিতেই আমরা নাকাল, অভ্যন্তরীণ সমস্যা আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে! এ এক নতুন অনিশ্চয়তা, গভীর অনিশ্চয়তা। এ সমস্যার কারণ জাতীয় নির্বাচন, যা হওয়ার কথা ২০২৪ সালের শুরুতে। স্বাভাবিকভাবে নির্বাচন একটি রুটিন বিষয়-ক্ষমতা বদলের হাতিয়ার। কিন্তু বিরোধী দল এবং সরকারি দলের বর্তমান অবস্থান দেখে মনে হচ্ছে, কপাল আমাদের খারাপ। কে ক্ষমতায় আসবে, কে আসবে না এটা পরের কথা। ঠিক হবে আগামী নির্বাচনের পর। কিন্তু সেটা রাজনৈতিক বিষয়। এ মুহূর্তে সমস্যা দেখা দিচ্ছে অর্থনীতি নিয়ে, ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে। ইতোমধ্যেই ২৮ তারিখে একদফা সমস্যা গেছে। বিরোধীদলীয় ও সরকারদলীয় পালটাপালটি সমাবেশ ছিল সেদিন। বিরোধীদলীয় সমাবেশকে কেন্দ্র করে সহিংস ঘটনা ঘটেছে। হাসপাতালের ভেতরেও আক্রমণ হয়েছে। একজন পুলিশ সদস্যের মৃত্যু হয়েছে। খবরে প্রকাশ, আরও দু-একজন নিহত হয়েছেন। অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মধ্যে ২৯ তারিখ ছিল সকাল-সন্ধ্যা হরতাল। রাস্তায় গাড়ি ছিল কম। গাড়ি-বাস পোড়ানোর ঘটনা ঘটেছে। ঢাকার সঙ্গে সারা দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হয়েছে। স্কুল-কলেজ ছিল প্রায় বন্ধ। অফিসে লোক সমাগম ছিল কম। চারদিকে থমথমে একটা অবস্থা। কী হবে, কী হতে পারে-এ আলোচনা সর্বত্র। তবে কি ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের পূর্বাবস্থায় আমরা ফিরে যাব? আবার কি চলতে থাকবে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি?
এ সবের মধ্যেই সর্বত্র আলোচ্য বিষয় প্রথমে দ্রব্যমূল্য, মানে মূল্যস্ফীতি। এ দুদিনেই দেখা যাচ্ছে পেঁয়াজ, আলু, ডিমের দাম বেড়েছে আবার। এমনিতেই মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের মতো এবং তা সরকারি হিসাবেই। এর মধ্যে আবার খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশের উপরে। টিসিবি খোলাবাজারে পণ্য বিক্রি করছে। সরকারি ধান সংগ্রহ অভিযান চলছে। ঢাকার সঙ্গে সারা দেশের পরিবহণ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হওয়ার অজুহাতে ব্যবসায়ীরা কাঁচাবাজারে জিনিসপত্রের দাম আবার বৃদ্ধি করছে। ৮০ থেকে ১০০ টাকার নিচে কোনো সবজি পাওয়া যায় না। এ কারণে মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত। তাদের চোখে-মুখে অন্ধকার। বিরোধী দল ঘোষিত ৩ দিনের ‘অবরোধ’ কর্মসূচি চলছে। অবরোধ মানে সামগ্রিকভাবে সারা দেশের অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্য বিঘ্নিত হওয়া। যদি এ অবস্থা দীর্ঘায়িত হয়, বিরোধী দলগুলো যদি তাদের ‘সর্বাত্মক’ কর্মসূচি অব্যাহত রাখে, তাহলে বলাই বাহুল্য, অর্থনীতি হবে বিপর্যস্ত।
আগেই উল্লেখ করেছি, বর্তমান কর্মকাণ্ডের প্রথম বলি হবে দ্রব্যমূল্য। এর পরিণাম সাধারণ মানুষের অবর্ণনীয় কষ্ট। তারপর ক্ষতিগ্রস্ত হবে একে একে অর্থনীতির সব সূচক। আমদানি, রপ্তানি, রেমিট্যান্স, ব্যাংক আমানত, রাজস্ব আদায়, শিল্প উৎপাদন, খেলাপি ঋণ-সব ক্ষেত্রেই ঘটবে সূচকের অবনমন। পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বলছে, দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৬ শতাংশের উপরে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক শেষ হয়েছে সেপ্টেম্বরে। এখন চলছে দ্বিতীয় প্রান্তিক। শুরু হয়েছে জাতীয় করমেলা, সংক্ষিপ্ত আকারে। এ মাসে সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধি পায়। কারণ এ মাসেই ‘রিটার্ন’ জমা দেওয়ার কাজ শেষ হবে। যদি পরিস্থিতি অস্বাভাবিক থাকে, তাহলে বলাই বাহুল্য, রাজস্ব আদায় বিঘ্নিত হবে। দেখা যাচ্ছে, জুলাই-সেপ্টেম্বরে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় হয়নি। ঘাটতি হচ্ছে ৮ হাজার কোটি টাকার উপরে। ফলে সরকারের ব্যয় সংকুলান হচ্ছে না। এর মধ্যে যদি চলমান সংকট দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে রাজস্ব পরিস্থিতি নাজুক হবে। সরকারি ব্যয় কম হচ্ছে রাজস্বের অভাবে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) টাকা খরচ করা যাচ্ছে না। আগামীতে চলমান সংকটে এডিপির কাজ নির্বিঘ্ন হতে হবে।