জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসে স্মৃতিচারণা করতে ভালো লাগে। আরও ভালো লাগে মনের গভীরে পুঞ্জীভূত স্মৃতির সঙ্গে না পাওয়ার বেদনামিশ্রিত বর্তমানকে মেলাতে। তাই অনেক অবাঞ্ছিত কথামালা। এটাই মনে হয় ইহজীবনের পরিণতি। মনে হয় বলছি এ কারণে যে, এর আগে কখনো জীবনসায়াহ্নে উপনীত হইনি। ‘নতুন নামে ডাকবে মোরে ডাকবে, বাঁধবে নতুন বাহুর ডোরে, আসব যাব চিরদিনের সেই আমি’ তত্ত্বে আমার বিশ্বাস নেই। আমার বিশ্বাস, অনন্ত এ জীবনের জীবন ও ঘটনার প্রতিটি মাহেন্দ্রক্ষণে আমরা চিরনতুন, অবিরাম নতুনের আলিঙ্গনে সামনে ধেয়ে চলেছি। ফিরে আসা নিয়মের লঙ্ঘন। কিছু স্মৃতি কখনো বেদনা হয়েও মনের কোণে উদ্ভাসিত হয়, যা হয়তো জনসমক্ষে বলা হয়ে ওঠে না। আবার গতকাল বা পরশু যে নীতিকথা ও যুক্তিতে অনড় ছিলাম, আজও যে সে একই বক্তব্যে অনড় থাকব, তা নাও হতে পারে। কারণ, সময় ও স্বার্থ পরিবর্তনশীল। জিহ্বার দায়িত্বজ্ঞান কম, সুস্থ চিন্তাচেতনা ও মনুষ্যত্বের বিকাশও সমাজ থেকে বিলীয়মান তাই।
এদেশের স্বাধীনতা এসেছিল আমার কিশোর ও উঠতি বয়সের সন্ধিক্ষণে। বাস্তবতার জ্ঞান যতটা না ছিল, তার চেয়ে বেশি ছিল দুরন্ত-বেয়াড়া একটা মন, আবেগপ্রবণতা। স্বাধীনতার পর রিলিফ হিসাবে অনেক কিছুই দেওয়া হতো। বণ্টন তালিকায় গ্রাম থেকে আমার ভাগে একবারই একটা বরাদ্দ এলো, ছোট্ট একটা এক ব্যাটারির রেডিও। রেডিওটা ছিল আমার সর্বক্ষণের সাথি। রিলিফ অনেক চুরি হতে দেখেছি, শুনেছিও। মহান নেতাকে মনের কষ্টে বলতে শুনেছি, ‘এত কম্বল এলো, আমার কম্বলটা কোথায়!’, ‘মানুষ পায় সোনার খনি, আমি পেয়েছি চোরের খনি’। মহান নেতার অকপট স্বীকারোক্তি তার প্রতি আমার কিশোর মনের ভক্তি বাড়িয়ে দিত। অপরিপক্ব বয়সের কারণে দেশের অবস্থা গভীরভাবে ভাবার অবকাশ তখনো মনে তেমন একটা জন্মায়নি। ভাবতাম, দেশটা কেবল স্বাধীন হলো; আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু এখন বুঝি। স্বাধীনতার পরপরই আমাদের অনেক নেতাকর্মীর নৈতিকতা ও মূল্যবোধের যে দীনতা শুরু হয়েছিল, মাঝপথে কখনো উনিশ-বিশ, কখনো পনেরো-বিশ হয়েছে মাত্র, তা থেকে পতন অদ্যাবধি অব্যাহত আছে এবং সেটা হালে দিগন্তবিস্তৃত ও সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে। তখন আমার আবেগপ্রবণতা ছিল রেডিওর যত গান নিয়ে। ছয় মাসের মধ্যে রেডিওতে যত গান শুনতাম, তার শুরুর বাজনাটা শুনলেই গানের কলিটা মুখে বলে দিতে পারতাম, যেমনটি বর্তমানে এদেশে কী হতে চলেছে পত্রিকার সংবাদ পড়ে আগেভাগেই মোটামুটি আঁচ করতে পারি। যাকে বলে, ‘উঠন্তি মুলো পত্তনেই চেনা যায়’।