বাংলাদেশ পুঁজিবাদী বিশ্বের একটি প্রান্তিক ও পশ্চাৎপদ রাষ্ট্র। এখানকার ব্যবস্থাটা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে পুরোপুরি আমলাতান্ত্রিক। অর্থাৎ একেবারেই গণতান্ত্রিক নয়। এ রাষ্ট্রে রাজনীতিকরা রাষ্ট্র শাসন করার সুযোগ সবসময় পান না। যখন পান তখন আসল কাজ আমলাতন্ত্রই করে এবং রাজনীতিকরা আমলাদের মতোই আচরণ করে সুখ পান। আমলাতন্ত্র স্থায়ী, রাজনীতিকরা ভাসমান; আজ আছে কাল নেই। রাজনৈতিক নেতা ভাই, আপা, ম্যাডাম নানাবিধ নামে অভিহিত হতে পারেন ঠিকই, কিন্তু আসলে তিনি একজন কর্তা। তাঁর দলের ভেতর কোনো গণতন্ত্র নেই। রাজনৈতিক দলের পক্ষে হবার কথা রাজনৈতিক শিক্ষার খোলামেলা স্থল; কিন্তু তেমন ব্যবস্থা কোনো দলেই নেই। রয়েছে একচ্ছত্র ব্যক্তি-নেতৃত্ব।
নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা আমলাদের মতোই আচরণ করেন। দূরে থাকেন জনতা থেকে; দায় রাখেন না জবাবদিহির এবং একজন আমলা যেমন নিজের টেবিলের পিয়নের সংখ্যা, বাসা, গাড়ি, ফোন, প্রটোকল বেতন-ভাতা ইত্যাদি সুখসুবিধা নিশ্চিত করতে ব্যস্ত থাকেন এবং ওসবের দ্বারা নিজের ক্ষমতার মাপজোক করেন; নির্বাচিত সংসদ সদস্যরাও অবিকল তেমনটি করে চলেছেন। তাদের দেখে আমলারা শিখবেন কী; তারা নিজেরাই আমলাদের দেখে শেখেন। সমাজে অনুকরণীয় ব্যক্তি রাজনীতিক, ব্যবসায়ী বা পেশাজীবী নন। অনুকরণীয় ব্যক্তি হচ্ছেন বড় আমলা।
ক্ষমতাও আসলে তাদের হাতেই। ব্রিটিশের রাষ্ট্র ছিল আমলাতন্ত্রের কঠিন ফ্রেমে আটকানো। পাকিস্তান আমলে সে কাঠামো ভাঙেনি। সেখানে অধিকাংশ সময়ে সামরিক আমলাতন্ত্রই রাষ্ট্র শাসন করেছে। তাদের আগমনের আগে কাজটি অসামরিক আমলারা করেছিলেন। বাংলাদেশ যুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত। কথা ছিল, এখানে আমলাতন্ত্র তার শক্তি হারাবে; কিন্তু হারায়নি। যুদ্ধটা রূপ নিয়েছিল জনযুদ্ধের, যে যুদ্ধে বিজয়ের পরে আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা আবার ফিরে আসবে– এমনটা আশঙ্কা করা যায়নি, কিন্তু এসেছে। সংসদীয় গণতন্ত্র পরিত্যক্ত হয়ে একদলীয় শাসন এসেছিল; তারপর এলো সামরিক শাসন, একের পর এক। বর্তমানে রাজনৈতিক সরকার দেশ শাসন করছে ঠিকই, কিন্তু আসল ক্ষমতা যে আমলাতন্ত্রের হাতেই রয়েছে, তা পুলিশ ও প্রশাসকদের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। এরশাদের পতন হতো না যদি সচিবালয়ে বিদ্রোহ দেখা না দিত। বিএনপি সরকারেরও প্রস্থান ঘটত না যদি জনতার তথাকথিত মঞ্চে বড় আমলারা গিয়ে উপস্থিত না হতেন। এখন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দলই মেনে নিয়েছে– তারা নির্বাচন পরিচালনায় অক্ষম (যার অর্থ অবশ্যই এটাও যে, তারা রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য একেবারেই অনির্ভরযোগ্য), যে জন্য তারা দ্বারস্থ হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের, যে সরকারের চরিত্র নির্ভেজালরূপেই আমলাতান্ত্রিক হতে বাধ্য। আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করার ফলে বিরোধীরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের জোর দাবি তুলেছে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন সরকার ক্ষমতা নিরঙ্কুশ রাখার অভিপ্রায়ে বিরোধীদের দাবি অগ্রাহ্য করে দেশে রাজনৈতিক নৈরাজ্যকে উস্কে দিয়েছে।