অন্যায়কে ন্যায় হিসেবে প্রমাণ করতে অনেক কোশেশ লাগতেই পারে, কিন্তু ন্যায়কে যদি ন্যায় হিসেবে প্রমাণিত হতে হয়, তবে ভেবে নিতে হয় যে, 'গোঁড়ায়’ 'সমস্যা' রয়ে গেছে। আচ্ছা, আমাদের গোঁড়া-ই বা কি, আবার কথিত সমস্যা-ই বা কি? 'গোঁড়া'র কথা আপাতত তোলা থাকুক, না হয়। তবে 'সমস্যা' হচ্ছে, দুনিয়ার অন্য সব মানুষদের মতই আমরাও যে মানুষ, সেই ধারণায় বিশ্বাস বজায় না রাখা। দুনিয়ার মানুষ যে প্রচুর কাঠখড় পুড়িয়েই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ও হচ্ছে, সেটা জানা ও বোঝার পরও আমরা বেবুঝের মত আচরণ করি। আমরা "হাজার বছর ধরে পথ হাঁটিতেছি, পৃথিবীর পথে..." বটে এবং ইতিমধ্যে "সিংহল সুমদ্র থেকে মালয় সাগর..." ছাড়িয়ে পৃথিবী আমাদের জন্য অনেক বিস্তৃতও হয়েছে। আমরা ইদানীং সেই মহা-পৃথিবীর মহা-পথে উঠতে চেষ্টা করছি এবং বলতেই হবে সেটা ব্যক্তি-চেষ্টার প্রতিফলন, যা বিদ্যমান দুনিয়ার অন্য সব ব্যক্তি-চেষ্টার সঙ্গে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ: কেউ কাউকে করে দেয় না, নিজেকেই করে নিতে হয়। দেখা যাচ্ছে যে, নিজেদের এই করণীয় নির্ধারণে ব্যক্তি কোনও পিছুটানে নেই, অন্য কারও দূতিয়ালিও যাচে না কিন্তু সমষ্টি তথা সরকার/বে-সরকার তাদের করণীয় নিয়ে গর্তে পড়লেই দ্বারে দ্বারে ঢুস্ মারে এবং তখনই নাবালকত্ব ধরা পরে। নির্বাচন-প্রক্রিয়া হাস্যকর করে তুলে বর্তমান গাড্ডায় পতিত হওয়া সেই নাবালকত্বের পরিচায়ক।
গত পঞ্চাশ বছরে এ-দেশের মানুষ অনেক সাবালক হয়েছে, নিজের স্বার্থ বুঝার ক্ষমতা তার অনেক বেড়েছে, কারণ, একান্ত নিজস্ব চেষ্টায় সে জীবনের স্বাদ পেয়েছে, জীবনকে ভালোবাসতে সে প্রলুব্ধ হচ্ছে, সেই ভালোবাসার ছিটেফোঁটা অন্যকে দিতেও সে আগ্রহী হচ্ছে এবং অধিকতর স্বাদু-জীবনের ধান্দায় সে অষ্ট-প্রহর ব্যস্ত আমাদের রাজনীতি সেই সাবালকত্বকে সম্যক উপলব্ধি করতে না পারার কারণে, মানুষ তিতি-বিরক্ত হয়ে রাজনীতি-প্রক্রিয়া থেকেই নিজেকে সরিয়ে রাখছে। মানুষের এই বিচ্ছিন্নতা বিভিন্ন কারণে সর্বনেশে, অন্যতম কারণ, কখনও সার্বভৌমত্ব যদি হুমকিতে পরে তখন মিলিটারি ছাড়া আর কাউকে পাওয়া যাবে না,এই যেমন '৭১-এ পাকিস্তানের-সার্বভৌমত্ব-হারানোর-প্রক্রিয়ায়, তৎকালীন পাকিস্তানের পূর্বাংশের জনগণকে পাশে পাওয়া যায়নি। আজকের দুনিয়ায় যুদ্ধ করে জমি-দখল করা লাগে না, অর্থনীতি দখল এবং রাজনীতি নিয়ন্ত্রণে নিলেই চলে। পূর্বে কথিত ও বর্তমানে দৃষ্ট দূতিয়ালি, এই নিয়ন্ত্রণ ও দখলের বায়নাপত্র। হাবে-ভাবে বোঝা যাচ্ছে যে, কাঁটাতারের ওই-পাড় এবং আটলান্টিকের হেঁই-পাড়, বাংলাদেশের বিষয়ে আপাতত At Per (একই সমতলে), অবশ্য বাংলাদেশের মানুষও 'অ-পাড় হয়ে বসে..' নেই।
এদেশীয় বুর্জোয়া এবং তাদের টাকার পরিমাণ কল্পনা করুন। এরা কি এম্নি এম্নি বসে থেকে নিজেদের কামানো টাকা এবং কামাই-যোগ্য টাকায় অন্য কাউকে ভাগ বসাতে দিবে? না, দিবে না। এরা হচ্ছে নতুন শ্রেণি যারা এদ্দিনে, দেশীয় অন্য সবার চেয়ে বেশি সক্ষম এবং বুদ্ধিমান। নিজেদের ব্যক্তিগত প্রয়োজনেই, আগামী দিনের বাংলাদেশে এদেরকে আরও সক্রিয় থাকতেই হবে। ‘আদি-সংগ্রহ’ (Primitive-accumulation) সঞ্জাত এই বাংলাদেশী বুর্জোয়ারা, জাতীয়-বুর্জোয়া হিসেবে রূপান্তরিত হবার স্বাভাবিক ক্ষমতা (আর্থিক ও মানসিক) এবং যুক্তি (জাতীয়তাবাদ) অর্জন করেছেন। এই বুর্জোয়াদের দ্বিতীয় প্রজন্ম এখন প্রায় মাঝবয়সী, দুনিয়ার সঙ্গে পরিচিত, দুনিয়া দেখেছেন ও দেখছেন, নিজেরা অনেক কিছু ভোগ করেছেন ও করছেন এবং সেটা দেখিয়ে আত্মপ্রসাদ পেয়েছেন ও অন্যদের মিনমিনে স্বীকৃতিও আদায় করেছেন। সুতরাং, সম্পদ এবং সম্পদ-উদ্ভূত প্রাথমিক তৃপ্তি তাদের হয়েছে, পরবর্তী-পর্যায়ের তৃপ্তি তারা খুঁজছেন এবং সেই তৃপ্তি চাখবার আগ্রহে আছেন। এখনই যদি এদেরকে তাদের কাঙ্ক্ষিত-তৃপ্তির সঙ্গে জাতীয়-প্রয়োজন সমূহের সংযোগ ঘটিয়ে না দেয়া যায়, তবে এদের সম্পদগুলো হয় বিদেশে আরও পাচার হবে নয়তো দেশে কম-লাভজনকভাবে ব্যবহার হবে।