এক কলামের একটা সংবাদ শিরোনাম—‘৪৭ বছর পর জিয়াকে হুকুমের আসামি করে হত্যা মামলা’। কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা বীর বিক্রম হত্যার ৪৭ বছর পর ঢাকার শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করেছেন তাঁর মেয়ে সংসদ সদস্য নাহিদ ইজাহার খান। মামলায় মেজর (অব.) আবদুল জলিলকে প্রধান আসামি করা হয়েছে। তৎকালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং জাসদ নেতা লে. কর্নেল (অব.) আবু তাহেরকে হুকুমের আসামি করা হয়েছে।
নাহিদ ইজাহার খান মামলায় অভিযোগ করেছেন, ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সেনাবাহিনীর বিপথগামী ও বিশৃঙ্খল সদস্যরা গুলি চালিয়ে তাঁর বাবাকে হত্যা করে। তাঁর সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের দুই সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ ও লে. কর্নেল হায়দারকেও হত্যা করা হয়। তখনকার সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান এবং জাসদ নেতা আবু তাহেরের নির্দেশে দশম ইস্ট বেঙ্গলের কর্মকর্তা, জেসিও ও সেনারা সংঘবদ্ধভাবে ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পিতভাবে ওই হত্যাকাণ্ড ঘটান (প্রথম আলো, ১২ মে ২০২৩)।
এই সংবাদে অনেক উপাদান আছে। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সকালের ঘটনাটি নিঃসন্দেহে বেদনাদায়ক ও বিয়োগান্ত। পঁচাত্তরের আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত দেশের পরিস্থিতি ছিল অনিশ্চিত ও টালমাটাল। অভ্যুত্থান আর পাল্টা–অভ্যুত্থানে সামরিক বাহিনীতে শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছিল। এ শুধু ক্ষমতার পালাবদল ছিল না। এর সঙ্গে জড়িয়ে ছিল নৃশংসতা। রক্ত ঝরেছিল অনেক। এ নিয়ে এখনো আলোচনা হয়, রাজনীতি হয়। কিন্তু ধোঁয়াশা কাটে না। কারণ, এর যথাযথ অনুসন্ধান হয় না।
প্রতিটি ঘটনার পক্ষ-বিপক্ষ আছে। আছে বিজয়ী আর পরাজিতের বয়ান। ৭ নভেম্বর কারও কাছে মুক্তিযোদ্ধা হত্যা দিবস, কারও কাছে সিপাহি জনতার অভ্যুত্থান দিবস, আবার কারও কাছে বিপ্লব ও সংহতি দিবস। কয়েক বছর আগে একটি টেলিভিশন টক শোতে আমার সঙ্গে ছিলেন নিহত দুই মুক্তিযোদ্ধার সন্তান মেহজাবীন খালেদ ও নাহিদ ইজাহার খান। নাহিদ বলছিলেন, ৭ নভেম্বর উপলক্ষে সেনানিবাসে ‘বড় খানা’ (গ্র্যান্ড ফিস্ট) হতো। ওই দিন অনেকের উল্লাসের ভিড়ে তাঁদের কান্না চাপা পড়ে যেত।
আমরা মোটামুটি জানি, পঁচাত্তরের ৩ নভেম্বর খালেদ মোশাররফকে সামনে রেখে একটি সেনা অভ্যুত্থান হয়েছিল। ৭ নভেম্বর আরেকটি অভ্যুত্থান হলে খালেদ মোশাররফ তাঁর দুই সঙ্গী ও সহকর্মী নাজমুল হুদা, হায়দারসহ নৃশংসভাবে খুন হন। প্রশ্ন হলো, এ রকম খুনোখুনিকে আমরা সামরিক অভ্যুত্থানের জয়-পরাজয়ের অনিবার্য পরিণতিতে নিয়তির বিধান হিসেবে মেনে নেব, নাকি আধুনিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আইনের শাসনের মধ্য থেকে কার কী দায়, সেটি নির্ধারণ করে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করব। আমরা জানি, ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের একটা বিচার হয়েছে। এ ব্যাপারে আমরা যদি সামাজিক-রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির ধারাবাহিকতা দেখতে চাই, তাহলে প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের বিচার হওয়া দরকার। দেখা দরকার হত্যাকাণ্ড ঘটনাচক্রে হয়েছে, নাকি ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পনা করে খুন করা হয়েছে।