আমাদের সমাজে নারীর পোশাক নিয়ে ‘আগ্রাসী’ তৎপরতা ক্রমেই বাড়ছে। অনেক ক্ষেত্রেই নারীর পোশাক হয়ে উঠেছে ব্যক্তিস্বাধীনতা দমনের হাতিয়ার। তথাকথিত শ্লীলতা-অশ্লীলতা নির্ণয়, ঐতিহ্য ও ধর্মপ্রতিষ্ঠারও অনুষঙ্গ। নারীর পোশাককে ঘিরে সমাজে বিভেদ, বিতর্ক ও রাজনীতি বাড়ছে। পৃথিবীতে পোশাকের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, মানুষ সম্ভবত প্রথম ঊর্ধ্বাঙ্গের পোশাক ব্যবহার শুরু করেছিল। এর কারণ হতে পারে, ঝোপঝাড়ে ফল-মূল সংগ্রহকারী মানুষের শরীর কাঁটার আঘাত থেকে রক্ষা ও শীতে উষ্ণতা পাওয়া। এরপর মানুষ যতই চিন্তাভাবনা, মনে-মননে বিকশিত হতে শুরু করেছে, শাসন ও নিয়মনীতি চালু করেছে, তখন থেকেই শুরু হয়েছে পোশাকের বৈচিত্র্য ও পোশাকের রাজনীতি। নারীর পোশাকের ক্ষেত্রে সামাজিক নিয়মাবলিতে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ধর্ম ও পুরুষতন্ত্র নানাভাবে নির্ধারকের ভূমিকা নিয়েছে। নারীরা দেহের কোন অংশ আবৃত করে প্রকাশ্যে বেরোবেন, কীভাবেই বা ‘শালীনতা’ ঐতিহ্য ও জাতিভেদের সীমানা নির্ধারিত হবে, তা নিয়ে পিতৃতন্ত্রের নানা শাখার মধ্যে মতভেদ ঘটেছে। নারীর পোশাক নিয়ে বিতর্ক ও রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরেই সমাজে প্রচলিত আছে। এ প্রসঙ্গে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা উল্লেখ করা যাক।
তখন সদ্য চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু হয়েছে। পুরনো জমিদারদের জমিদারিতে থাকার বিধান পুরনো হয়ে যায়। গ্রাম-পরগনা ছেড়ে দলে দলে জমিদার-ভূস্বামী-সচ্ছল-অর্থবানরা কলকাতায় যাচ্ছেন। একে একে জমিদারদের প্রাসাদ গড়ে উঠছে আলোকোজ্জ্বল ইংরেজদের প্রতিষ্ঠিত কলকাতার প্রাণকেন্দ্রে। কলকাতার নব্য ভদ্রলোকরা তত দিনে ‘ছোটলোকদের’ টাইট দিতে শিখে গেছেন। তারা দেশের তাঁতিদের বোনা পাতলা কাপড়কে অশ্লীল, অশালীন আখ্যায়িত করলেন। এই সূক্ষ্ম কাপড়ে নাকি আব্রু রক্ষা হয় না। সূক্ষ্ম কাপড় তৈরিতে বাংলার তাঁতিদের অসীম দক্ষতা ছিল, তারা ব্রিটিশদের সুতি কাপড় পরা শিখিয়েছিল। যে কাপড় পাল-সেন-সুলতান-মোগল-নবাবি আমলে শাসকদের গর্বের ছিল, অশ্লীল অভিধার বদলে পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিল। নব্য অভিজাতরা অশ্লীলতা রোধে জমিদারদের চাপ দিলেন সেই সূক্ষ্ম কাপড় উৎপাদন বন্ধের জন্য। প্রভুদের তৈরি ম্যানচেস্টারের মিলের মোটা কাপড়ের আর সূক্ষ্ম প্রতিদ্বন্দ্বী রইল না। ‘উনিশ শতকের কলকাতা ও সরস্বতীর ইতর সন্তান’ বইয়ে সুমন্ত্র বন্দ্যোপাধ্যায় এমনটাই লিখেছেন। মহাভারতে বর্ণিত দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণও ছিল নারীর পোশাকের রাজনীতিই। আসলে নারীর সমাজ নির্মিত একটি চেহারা আছে এবং সেই চেহারাটা হিন্দুদের জন্য এক রকম, ধর্মনিরপেক্ষদের জন্য এক রকম, নারীবাদীদের জন্য এক রকম, মুসলমানদের জন্য এক রকম, খ্রিস্টান-বৌদ্ধদের জন্য আরেক রকম। একশ্রেণির মানুষ এই বিষয়গুলোকে হাতিয়ার করে সামাজিক বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা চালায়। নানা কুতর্কে বিভেদের রেখাটাকে বাড়িয়ে তোলার চেষ্টা করেন। তাই তো কিছুদিন পরপর নারীর পোশাক নিয়ে আলোচনার ঝড় ওঠে। যে যার মতাদর্শ ও বুঝমতো নারী কোন পোশাক পরবে, আর কোনটা পরবে না সে বিষয়ে মতামত ব্যক্ত করেন। তাতে সমাজ মনস্তত্ত্বেরই প্রকাশ ঘটে।
সমাজ বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেশে পোশাকও বিবর্তিত হয়েছে। আবার শিক্ষা, ধর্মীয় রীতিনীতির চর্চা, নগরায়ণও পোশাকের ওপর প্রভাব ফেলেছে। একসময় অল্প কিছু চাকরিজীবী ছাড়া অন্য পুরুষরা লুঙ্গি পরতেন। এখন কৃষকসহ শ্রমজীবী শ্রেণি ছাড়া অন্যরা ঘরের বাইরে খুব একটা লুঙ্গি পরেন না। শিক্ষিত শ্রেণির মধ্যে প্যান্ট, ট্রাউজার, শর্টস পরার প্রবণতা বাড়ছে। মেয়েরা শাড়ি বাদ দিয়ে সালোয়ার-কামিজ পরছেন। একসময় হিন্দু নারীরা বিশাল ঘোমটা টেনে কাপড় পরতেন। কালের বিবর্তনে ঘোমটা ছোট হয়েছে কিংবা উঠে গেছে। পাশাপাশি সমাজে সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর মধ্যে ধর্মীয় ধ্যানধারণা বৃদ্ধির কারণে বোরকা পরার প্রচলন বেড়েছে। এটা কূটতর্কের বিষয় নয়, এটা একটা প্রবণতা ও বাস্তবতা। এর সঙ্গে ধর্মবিশ্বাসের যোগ আছে। সমাজ মনস্তত্ত্ব অস্বীকার করে বোরকার বিরুদ্ধে গর্জন করলেই যেমন এর ব্যবহারকারীর সংখ্যা কমবে না, আবার বোরকার পক্ষে ব্যাপক প্রচারণা চালালেও সবাই বোরকা পরবে না। আমাদের সমাজটা নানা ধর্ম-বর্ণ-সংস্কৃতি-মূল্যবোধ-রুচির মানুষ নিয়ে গঠিত। সেখানে চিন্তাভাবনা, আচরণ, পোশাক ইত্যাদির ভিন্নতা থাকবেই। কোনো সমাজে সবাই একই রকম পোশাক পরবে, একই ধরনের চিন্তা ও আচরণ করবে এটা অলীক কল্পনা মাত্র। ভিন্নতা ও বৈচিত্র্যকে মান্যতা দিতেই হবে। এটা অনিবার্য। সবাইকে এক ছকে সাজানো যাবে না। নারীর পোশাক নিয়ে সমালোচনা করাটা একটা সামাজিক অসুখ। সমাজ-নির্মিত যে কাক্সিক্ষত ও স্বীকৃত নারীত্ব, এই লিঙ্গ-নির্মাণের অনেকগুলো বিধিনিষেধের একটি প্রধান ক্ষেত্র মেয়েদের পোশাক। পোশাকের ক্ষেত্রে ‘চয়েস’ বা ইচ্ছেকেই অনেকে প্রধান বিবেচ্য বলে মনে করেন। যদিও প্রশ্ন থেকে যায়, মেয়েরা যা পরেন, যেভাবে পরেন, তা কি তাদের নিজস্ব রুচি-পছন্দ অনুসারেই? না কি, তাদের বেলায় পোশাক মানে সত্যিই পররুচির খেলা? নারীর কাছে ‘পররুচি’-র অর্থ আসলে পুরুষের রুচি, যার ভিত্তিতে তাদের পোশাক নির্ধারিত হয়ে থাকে। পোশাকের স্বাধীনতার অথবা স্বাচ্ছন্দ্যের নামে মেয়েরা যা পরেন, পরতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন, আজও তা সুকৌশলে আমাদের পুরুষশাসিত সমাজই নির্ধারণ করে দেয়। পশ্চিম হোক বা পূর্ব, ভোগবাদ হোক বা রক্ষণশীল, বোরকা হোক বা মিনি স্কার্ট পুরুষচক্ষুই আজও নিয়ন্ত্রণ করে নারীর পোশাকের স্বাধীনতা।
পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা সমাজ-সংসারের একটা ছক এঁকে দিয়েছে। একেই আমরা কখনো প্রাকৃতিক, কখনো ধর্মীয় বিধান হিসেবে মেনে নিয়েছি। এর বাইরে জগৎ হতে পারে, হওয়া সম্ভব এটা ভাবতে সমাজ, সমাজের প্রথাবদ্ধ মানুষরা নারাজ। এই বিশ্বাস ভাঙতে গেলে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। ‘পৃথিবীর ভবিষ্যৎ’ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করা হয়। জীবনযাপনের অনেক পথ আছে। পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা এর কয়েকটাকে বড় করে দেখিয়েছে, বিশেষ মাহাত্ম্য দিয়েছে গায়ের জোরে। নারী এই, পুরুষ এই, এই রকমই তাদের হতে হবে, এমন পোশাক পরতে হবে, এভাবে চলতে হবে, এভাবে যৌনতার চর্চা করতে হবে, এটা আমাদের বদ্ধমূল ধারণা। পুরুষতান্ত্রিক ধ্যানধারণা আমাদের মধ্যে এই ‘মূল্যবোধ’ দৃঢ়ভাবে প্রোথিত করে দিয়েছে। কিন্তু এমন যুক্তিও প্রবল যে, বহুজনকে নিয়েই সমাজ। সমাজের প্রত্যেকে যেন নিজের মতো বাঁচতে পারে, নিজের পছন্দ অনুযায়ী চলতে পারে, বলতে পারে, পরতে পারে, সেটাই আজকের যুগের সমাজের এবং মানবাধিকারের মূল কথা। যা কিছু চলে আসছে ধর্ম কিংবা সামাজিক নিয়ম হিসেবে, যা আমরা বাইরে থেকে দেখে অভ্যস্ত, এই ‘বাইরের ঠিক’ সব সময় ঠিক নয়। ভেতরের বা সত্তার বিকাশই আসল কথা। সত্তাকে উপলব্ধি করতে হয়। তবে তাকে চিনতে পারা যায়। আমাদের সমাজে প্রচলিত ধর্মতান্ত্রিক ও পিতৃতন্ত্রের খাঁচায় সবাইকে ‘ফিট’ করতে চাওয়া হয়। কেউ ফিট না করলে তাকে বাধ্য করা হয়। যে ফিট করছে না তাকে তার মতো থাকতে দেওয়াটাই যে মানবাধিকারের মূল কথা এটা সামাজিক মানুষরা, এমনকি রাষ্ট্র পর্যন্ত প্রায়ই ভুলে যায়।