জলবায়ু পরিবর্তনের ক্রমবর্ধমান অভিঘাত মোকাবিলায় সবুজায়ন যখন আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি জরুরি; তখন সমকালসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে দেশের বিভিন্ন বনাঞ্চল নিয়ে হতাশাজনক চিত্রই প্রকাশিত হতে দেখি আমরা। এই তথ্য ও চিত্র পুরোনো যে, আমাদের প্রয়োজনীয় বনাঞ্চলের অনুপাত কাগজে-কলমে 'সংরক্ষিত' থাকলেও ভেতরে ভেতরে ফোকলা হয়ে যাচ্ছে। এতটুকু 'চক্ষুলজ্জা' না করে এক পাশ থেকে বন উজাড় হওয়ার চিত্রও সংবাদমাধ্যমে বিরল নয়। আর সবুজ বন উজাড় হওয়ার পর ধূসর ভূমি কীভাবে দখলে যায়, তার খণ্ডচিত্র ফুটে উঠেছে বুধবার সমকালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে। এতে দেখা যাচ্ছে- দিনাজপুরে বনের জমি দখলের রীতিমতো 'মহোৎসব' চলছে। সেখানকার ৮ উপজেলায় ৬ হাজার একরের বেশি যে জমি বেদখল হয়ে গেছে, তা জেলার মোট বনভূমির এক-তৃতীংয়াংশ। বলা বাহুল্য, এই চিত্র কেবল দিনাজপুরের নয়। আমরা জানি, বনভূমি কেন উজাড় হয়, বনের ভূমি কেন দখল হয়। এর কারণ হিসেবে বিভিন্ন নেতিবাচক প্রপঞ্চের কথাও শোনা যায়। কিন্তু সেই তুলনায় গোড়ার গলদটি সম্ভবত অনালোচিতই রয়ে যায়।
আমরা মনে করি, বন সংরক্ষণবিষয়ক প্রায় শতবর্ষী আইনটিতে আরও স্পষ্টতা প্রয়োজন। এতে বনের সংজ্ঞা ও সংরক্ষণ প্রক্রিয়া সম্পর্কে স্পষ্ট করে কিছু বলা নেই। এমনকি পরবর্তীকালে জারি করা প্রজ্ঞাপনেও এই অস্পষ্টতা কাটেনি। এর ফলে সংরক্ষিত বনাঞ্চলসহ বনভূমির ঢালাও ব্যবহার হচ্ছে 'পরিস্থিতি' অনুযায়ী। আমরা দেখছি, বন আইনে করাতকল বিধিমালায় পৌর এলাকায় করাতকল স্থাপন ও পরিচালনার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু বলা হয়নি যে, বনাঞ্চল থেকে সেই পৌর এলাকার দূরত্ব কতখানি হতে হবে। আইনের এই ফাঁক গলিয়ে সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘেঁষে আক্ষরিক অর্থেই শত শত করাতকল থাকার খবর বিভিন্ন সময় সংবাদমাধ্যমে আসতে দেখা যায়। স্বাভাবিকভাবেই এসব করাতকলের 'খোরাক' জোটে বন থেকেই। দেশের পরিবেশবাদী বিভিন্ন পক্ষের দাবির মুখে বন আইন 'যুগোপযোগী' করার উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা শেষ পর্যন্ত ইংরেজি থেকে বাংলায় ভাষান্তরে পর্যবসিত হয়েছে। আইনের যদি অস্পষ্টতা থাকে, তাহলে বন রক্ষা হবে কীভাবে? সহযোগী একটি দৈনিকে গত বছর প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা গিয়েছিল- বনের জমি নিয়ে পরিচালিত মামলাগুলোর প্রতি চারটির একটিতে হারে বন বিভাগ। আইনগত স্পষ্টতা থাকলে এই হার নিঃসন্দেহে নিয়ন্ত্রণে আসত।
আমরা দেখি, জটিল ভূমি ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে খোদ ব্যক্তি মালিকানাধীন জমিও বেহাত হয়ে যায়। বিভিন্ন নগর বা বন্দরে সরকারি খাস জমিরও 'ক্রয়সূত্রে' মালিক বনে যায় অনেকে। সেদিক থেকে বনের জমি বরং অনেক 'সহজ' শিকার। পরিস্থিতি কতটা গুরুতর আকার ধারণ করেছে, এর অকাট্য প্রমাণ আমরা সাম্প্রতিক সময়ে দেখেছি ময়মনসিংহের ভালুকায়। সেখানে বন বিভাগের বিট কর্মকর্তার কার্যালয় যেখানে, সেই এলাকার 'মালিকানা' চলে গিয়েছিল অন্য ব্যক্তির নামে! দিনাজপুর ছাড়াও দেশের বিভিন্ন এলাকায় বনের ভূমি দখলের হার কীভাবে বেড়ে গেছে, আমরা দেখেছিলাম গত বছর মার্চে সমকালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে। এতে দেখা গিয়েছিল- দেশে গত দেড় যুগে উজাড় হয়ে গেছে পৌনে চার লাখ একরের বেশি বনভূমি, যা মোট বনভূমির প্রায় আট শতাংশ।