অনেক দিন ধরেই আমাদের শিক্ষাঙ্গনে প্রবল উত্তেজনাকর কিছু ঘটনা আমরা লক্ষ করেছি। এমনিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অশান্ত ছাত্ররাজনীতির একতরফা শাসনে উত্তপ্ত হয়ে আছে আর অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে শুরু করে ভাইস চ্যান্সেলর পর্যন্ত বিতর্কিত হয়ে পড়েছে। সেগুলো বড় রাজনৈতিক বিষয়। কিন্তু এখন মুন্সীগঞ্জ থেকে শুরু করে সাভার হয়ে নড়াইলে যা ঘটছে তা রীতিমতো আমাদের সমাজে গভীর অসুখের প্রতিফলন। এরই মধ্যে নড়াইলের লোহাগড়ায় আবারও ফেইসবুক-ঘটিত বিষয়গুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এই ফেইসবুকের বিষয়টির সূচনা সেই রামুতে; যেখানে বৌদ্ধ মন্দিরগুলোতে গৌতম বুদ্ধের মূর্তির ওপর এবং বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মানুষদের ওপর হামলা করা হয়েছিল। এবারে মুন্সীগঞ্জে শিক্ষক হৃদয় ম-লকে নিয়ে যা হলো তা একেবারেই ভাবনার অতীত। শিক্ষার ওপর বিশেষ করে বিজ্ঞান শিক্ষার ওপর সরাসরি আক্রমণ। কারণ এই ইতিহাস সেই গ্যালিলিওর আমল থেকে। গ্যালিলিও প্রমাণ করেছিলেন সূর্য স্থির, পৃথিবী তার কক্ষপথে পরিভ্রমণ করে। বিষয়টি বাইবেলপন্থিরা মেনে নিতে পারেননি। তারা গ্যালিলিওকে বাধ্য করে তার তত্ত্বকে মিথ্যে বলার জন্য। কিন্তু বিজ্ঞানের শক্তি এ রকমই যে গ্যালিলিওর তত্ত্বটি সত্য বলে প্রমাণ হয়ে গেল। ধর্মযাজকরা এই অমোঘ সত্যকে অস্বীকার করার চেষ্টা করেছিলেন। তারা ইহলৌকিকতার বিরুদ্ধে এবং পরলোকের সপক্ষে তাদের বাণী পৌঁছে দেন নানা ধরনের ভয়ভীতির মাধ্যমে। এই ধারাবাহিকতা এখনো চলমান আছে।
সম্প্রতি একটি মঞ্চনাটক দেখতে গিয়ে এক মহৎ বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের উন্মোচন দেখতে পেলাম। বাতিঘর প্রযোজিত নাটকটির নাম ‘মাংকি ট্রায়াল’। নাটকটির সারসংক্ষেপ এ রকম। ‘১৯২৫ সালে, আমেরিকার হিলসবোরো শহরের পাবলিক স্কুলশিক্ষক বার্ট্রাম কেইটসের ওপর বাটলার আইন লঙ্ঘন করায় মামলা হয়। বাটলার আইন এমন এক রাষ্ট্রীয় আইন, যা পাবলিক স্কুলের শিক্ষকদের ক্লাসে সৃষ্টিবাদের পরিবর্তে বিবর্তনবাদ শেখানো নিষিদ্ধ করে। লেখক, সাংবাদিক ও সমালোচক ই. কে. হর্নবেকের রিপোর্টিংয়ের মাধ্যমে এই মামলাটি মিডিয়ায় তীব্রভাবে আলোচিত হয় ও পুরো দেশের মনোযোগ আকর্ষণ করে। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী হিসেবে ম্যাথিউ হ্যারিসন ব্র্যাডি এবং আসামি পক্ষের আইনজীবী হিসেবে হেনরি ড্রামন্ড আসেন মামলাটি লড়তে। বিবিধ ঘটনার উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে মামলাটি এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্তে পৌঁছায়, যা আদতে আমেরিকার ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। গল্পটি ১৯২৫ সালে আমেরিকার বহুল আলোচিত মামলা ‘স্কোপস মাংকি ট্রায়াল’-এর সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত’।
নাটকটির গল্প যেখান থেকে শুরু সেটি হচ্ছে বিজ্ঞানের শিক্ষক বিবর্তনবাদপরায়ণ এটাই তার অপরাধ। কিন্তু তার পক্ষের যিনি উকিল তিনি কোর্টকে বোঝানোর চেষ্টা করেন পৃথিবীতে অনেক জ্ঞান-বিজ্ঞানের তত্ত্ব আছে। সেসব তত্ত্বের গুণাগুণ বোঝার জন্য সব ধরনের জ্ঞানই মানুষের জানা প্রয়োজন, তা না হলে মানুষের মন বিকশিত হয় না, সে বঞ্চিত হয় পৃথিবীর মহত্তম শিক্ষার মুক্তচিন্তা থেকে। অসাধারণ এই প্রযোজনাটি দর্শকদের নানাভাবে সমৃদ্ধ করেছে। এই মুক্তচিন্তার অপরাধে গত দুই দশকে বাংলাদেশেরই অনেক মেধাবী প্রাণকে রক্তাক্ত হতে দেখা গেছে। শুধু একটি চিন্তার কারণে একটি মানুষকে হত্যা করে ফেলতে হবে এ কেমন শিক্ষাব্যবস্থা! জ্ঞানকে আবদ্ধ করে রাখলে যে কূপম-ূকতার সৃষ্টি হয়, তার পক্ষে হত্যা-নির্যাতন প্রগতির পথকে রুদ্ধ করা এসবই সম্ভব। বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ এই অসুখে আক্রান্ত। এ ধরনের শিক্ষা মানুষকে সত্যানুসন্ধানী হতে দেয় না। ফেইসবুকে কী লেখা হলো, তা কতটা সত্য, কিংবা যার নামে লেখা হলো সেটাই-বা সত্য কি না, তার জন্য বিন্দুমাত্র অপেক্ষা করতে এসব লোক রাজি না। তাদের দরকার একটা শিকার এবং এই শিকার যখন সামনে পাওয়া গেল তখন তাকে ছাড়া যায় না। যদি কোনো ব্যক্তিবিশেষের ব্যাপার হয় তাহলেই-বা তাদের মন্দির ও উপাসনালয়কে ভাঙচুর করতে হবে, সেই ধর্মাবলম্বীদের ঘরবাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিতে হবে কেন?