প্রাথমিকে পড়ার সময়ে আমরা একটি কবিতা পড়েছিলাম‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’। কবি কাজী কাদের নেওয়াজ। আমাদের পাঠ্যপুস্তকে কবিতাটি অন্তর্ভুক্ত ছিল। সেই সময়ে কবিতাটি আমাদের মুখস্থ করতে হয়েছিল। এত বছর পরে কবিতাটি এখন আর পুরোপুরি মনে নেই। সম্প্রতি কাছাকাছি সময়ে তিনজন শিক্ষকের করুণ পরিণতি শৈশবের কবিতার কাছে নিয়ে গেল। শৈশবে কবিতা পড়া মানে ছিল মুখস্থ করা। পরীক্ষায় প্রশ্নের উত্তর লিখা। এর বাইরে আর কিছু ভাববার বয়স তখন ছিল না। আমাদের প্রাইমারিতে বাংলা পড়াতেন কাশেম স্যার। তিনি ব্ল্যাক বোর্ডে ছবি এঁকে পড়াতেন। মনে পড়ে ‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’ কবিতায় শিক্ষকের মর্যাদার কথা বর্ণনা করা হয়েছিল। শিক্ষক একজন সাধারণ মানুষ হওয়া সত্ত্বেও বাদশাহ আলমগীরের ছেলের দ্বারা পায়ে পানি ঢেলে নিয়েছিলেন। কিন্তু বাদশাহ আলমগীর এতে সন্তুষ্ট ছিলেন না। বাদশাহ আলমগীর প্রত্যাশা করেছিলেন তার সন্তান পানি ঢেলে নিজ হাতে শিক্ষকের পা ধুয়ে দেবেন। তবেই না তার সন্তান নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও দেশপ্রেম নিয়ে দেশের একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে। বাদশাহ আলমগীর উপলব্ধি করেছিলেন, যে ছাত্র শিক্ষকের সেবা করতে জানে না, সে কখনো পরিবার, সমাজ ও দেশের উপযোগী মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পারে না। একজন শিক্ষকের মর্যাদা অন্য সবার উপরে, সত্য ও ন্যায়ের পথে থাকলে কোনো রাজা-বাদশাহকে ভয় করার কারণ নেই, মানুষের মর্যাদা তার প্রাণের চেয়ে অনেক বড়।
এখন সেই বাদশাহী আমল নেই সত্যি। তাই বলে শিক্ষকের মর্যাদা কি থাকবে না? খুব বেশি দূর যেতে হবে না। অল্প কয়েক বছর আগের ঘটনা। আমাদের সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা গিয়েছেন বাংলা একাডেমিতে বইমেলা উদ্বোধন করতে। সেখানে ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। বইমেলার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পর প্রধানমন্ত্রী ঘুরে ঘুরে বই দেখছেন। একসময়ে তার নজরে এলো অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের কাঁধ থেকে চাদর মাটিতে পড়ে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী দ্রুত নিজের হাতে শিক্ষকের চাদর ঠিক করে তুলে দিলেন। এই ঘটনার ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ল। সবাই প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা করলেন। শিক্ষকের প্রতি এই আচরণ ও তার ফলে সমাজে সৃষ্ট প্রতিক্রিয়া এই বার্তাই কি আমাদের দিয়ে গেল নাশিক্ষাগুরুর প্রতি সম্মান দেখালে প্রকারান্তরে আমরাই বড় হই। কিন্তু এই সমাজে বিপরীত দৃশ্যও অনেক। প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষকের প্রতি এমন ব্যবহারের পরেই আরেকজন সংসদ সদস্যের কথা বলতে চাই। যিনি একইসাথে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একই সংসদে আইনপ্রণেতা হিসেবে ছিলেন। এটাও বছর কয়েক আগের ঘটনা। শ্রেণিকক্ষে ‘ধর্মীয় কটূক্তির’ অভিযোগে নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে স্থানীয় সাংসদ (জাতীয় পার্টি) এ কে এম সেলিম ওসমান আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতিতেই মারধর ও কান ধরে ওঠবস করান। সেই ঘটনায় দেশব্যাপী তুমুল সমালোচনা ও প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। তাতে ক্ষমতার শীর্ষে অবস্থানকারীদের নীতিগত কোনো সিদ্ধান্তে বদল ঘটেনি। সমাজেরও কোনো গুণগত পরিবর্তন দেখা যায়নি। পরিবর্তন যে হয়নি তার প্রমাণ সম্প্রতি তিনজন শিক্ষকের সঙ্গে ঘটে যাওয়া অমানবিক ও নির্দয় ঘটনাগুলো।