দুঃখ ও সুখের দিনে এক হওয়ার অনুভবই আসলে জাতীয়তাবাদের মূলকথা। একাত্তরে বঙ্গবন্ধুর ডাকে দুঃখের দিনে ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি-পেশার মানুষ মুক্তির সংগ্রামে এক হয়েছিল। আবার ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি জাতির পিতার স্বাধীন দেশে প্রত্যাবর্তনের আনন্দের দিনেও বাঙালি এক হয়েছিল। শ্মশান বাংলাকে সোনার বাংলায় রূপান্তরের সেই মহিমান্বিত নেতৃত্বের পুনরাবৃত্তি আমরা স্বদেশের অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণে বঙ্গবন্ধুকন্যার উন্নয়ন অভিযাত্রায় দেখতে পেয়েছি।
শুরুতে তা ছিল দুঃখের আখ্যান। স্বদেশের কতিপয় স্বার্থান্বেষী মানুষের ষড়যন্ত্রে বাংলাদেশ ও তার নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাংকের অবিবেচক তৎকালীন নেতৃত্বের নির্দয় আক্রমণের সেই দিনগুলোর কথা ভোলার নয়। সেই আঘাতকে ঠাণ্ডা মাথায় মোকাবেলা করে বঙ্গবন্ধুকন্যা নিজেদের অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণের এক সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে ঢাকার গণভবনে বিশ্বব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট কার্গিলকে যা বলেছিলেন তার সঙ্গে পদ্মা সেতু নিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যার সিদ্ধান্ত মিলে যায়। পাকিস্তানের বিদেশি ঋণ ভাগাভাগি করে নেওয়ার চাপ দেওয়ার সময় কার্গিল বঙ্গবন্ধুকে খাদ্য সাহায্য বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরিণতির কথা জানিয়েছিলেন। এর জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, প্রয়োজনে তাঁর দেশের মানুষ ঘাস খাবে, তবু বিশ্বব্যাংকের অন্যায় আবদার মেনে নেবে না। এরপর উন্নয়ন সহযোগীরা বাংলাদেশের দাবিমতোই এ প্রশ্নের মীমাংসা করতে বাধ্য হয়। বিশ্বব্যাংকের অন্যায় আক্রমণের জবাবে নিজেদের অর্থে পদ্মা সেতু গড়ার প্রত্যয় ঘোষণা করে বঙ্গবন্ধুকন্যাও সেই একই রকম দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছেন।
আত্মশক্তিতে বলীয়ান বঙ্গবন্ধুকন্যার বিচক্ষণ নেতৃত্বে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের আজ শুভ দিন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেতৃত্বে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত (বিশেষ করে অগ্রণী ব্যাংক) এই মেগাপ্রকল্পের পুরো বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহ করেছে। আর এই বিদেশি মুদ্রা মূলত আমাদের দেশপ্রেমিক পরিশ্রমী প্রবাসী ভাই-বোনরাই আয় করে ব্যাংকিং চ্যানেলে দেশে পাঠিয়েছেন। পোশাকশিল্পে কর্মরত কৃষককন্যাদের পরিশ্রমের ফসল রপ্তানি আয়ও এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। সাড়ে সাত বছর ধরে প্রতিকূল প্রাকৃতিক ও কভিড-১৯-এর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে এই সেতুর নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। আমাজন নদীর পরই খরস্রোতা পদ্মার ওপর ১২৮ মিটার দীর্ঘ গভীরতম পাইলিং করে পদ্মা সেতুর দ্বিতল কাঠামো স্থাপন করা হয়েছে। এই সেতুর ওপরের তলা দিয়ে যানবাহন এবং নিচের তলা দিয়ে রেল চলবে। একই সঙ্গে নিচের তলায় রয়েছে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেটের লাইন। প্রযুক্তির বিস্ময়কর ব্যবহারে গড়ে ওঠা পদ্মা সেতুর জন্য সিমেন্ট, রড ও অন্যান্য উপকরণের বেশির ভাগই জুগিয়েছে বাংলাদেশের শিল্প খাত। আন্তর্জাতিক ঠিকাদারদের পাশাপাশি আব্দুল মোনেম গ্রুপের মতো স্বদেশি ঠিকাদাররাও অসাধারণ অবদান রেখেছেন এই সেতু নির্মাণে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রকৌশল বিভাগের সমন্বয় ও কর্মতৎপরতাও ছিল দেখার মতো। এই সেতুর কারিগরি কমিটির প্রধান প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী এক আলাপচারিতায় আমাকে জানিয়েছিলেন যে পদ্মা সেতু নির্মাণের অভিজ্ঞতায় পোক্ত হয়ে আমাদের প্রকৌশলীরা ভবিষ্যতে আরো বড় সেতু নিজেরাই নির্মাণ করতে পারবেন।