কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রেও ছিল ‘আয় অনুযায়ী ব্যয়ের বাজেট’ তৈরি এবং বরং তার ফলে যদি কিছু উদ্বৃত্ত পাওয়া যায়, সেটি ভবিষ্যতের দৈবদুর্বিপাকের জন্য রাখা। ব্যয়কে রাজস্ব আয় অনুগামী করা না হলে ব্যয়ে স্বেচ্ছাচারিতা ঠেকানো যায় না, ভবিষ্যতের জন্য উদ্বৃত্ত তো দূরের কথা, ব্যয় ধারকর্জ করে চালিয়ে ভবিষ্যতের জন্য দুর্বিপাকের পাল্লা ভারী করা হয়। ইদানীং জনগণের জন্য উন্নয়ন ও কল্যাণের নামে বাহুল্য ব্যয়ের জন্য বাজেটে ব্যয়কে অগ্রগণ্য ভাবা হয় এবং সম্ভব হবে না জেনেও আয় অর্জনের ওপর তা চাপানো হয়। এ অবস্থায় এমন সব খাতে ব্যয় বাড়ানো হয়, যেখানে নিয়ন্ত্রণের সুযোগ থাকে না, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিকরণের উপায় তাগিদসহ অপচয় আত্মসাৎ দুর্নীতি ঠেকানোর নামমাত্র উদ্যোগ মেলে না। বাজেটীয় নিয়ন্ত্রণের যেসব পদ্ধতি প্রক্রিয়া প্রভিশন সংবিধানে, সংসদ কার্য পরিচালনা বিধি ও কোডে, ম্যানুয়ালে উল্লিখিত আছে তা কৌটিল্য, কেইনস, অ্যাডাম স্মিথ অনুযায়ী ঠিক থাকলেও তা অনুসরণের সময় যেন কারোরই নেই। তাই জনগণের জাতীয় বাজেটে তেলো মাথায় তেল দিয়ে পক্ষপাতিত্বের, বৈষম্য সৃষ্টির সুযোগ, মৌলিক অধিকার বঞ্চিতকরণের সব ‘আয়োজন’ থাকে। জনগণের পক্ষে বাজেট প্রস্তাব পরীক্ষা-পর্যালোচনা, বিচার-বিশ্লেষণের দায়িত্ব যদি পালিত না হয়, সম্পূরক বা সংশোধিত বাজেট যদি বিনা জিজ্ঞাসাবাদে, বাক্যব্যয়ে, কণ্ঠভোটেই সব ‘আয়োজন’ পাস হয়ে যায়, তাহলে বাজেটের কার্যকারিতা অর্থবহ হয় না।
এটা সবার জানা যে বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চম ভাগে, আইনসভা অধ্যায়ে, দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে, ‘আইন প্রণয়ন ও অর্থসংক্রান্ত পদ্ধতি’ অনুযায়ী ৮১ অনুচ্ছেদে সংজ্ঞায়িত ‘অর্থবিল’ই ব্যাবহারিক অর্থে বাজেট। সংবিধানের কোথাও বাজেট শব্দের নাম-নিশানা নেই অথচ লোকসমাজে বাজেট একটি বহুল ব্যবহৃত ও পরিচিত শব্দ। সংসদে সম্পূরক এবং নতুন অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব পেশকালে ট্রেজারি বেঞ্চ থেকে যে ‘বাজেট বত্তৃদ্ধতা’ দেওয়া হয় তা আইনত বাজেট নয়, সেটি পারতপক্ষে অর্থবিলের নির্বাহী সারাংশ; এবং এটিকে বড়জোর সরকারের ‘রাজনৈতিক অর্থনীতির বার্ষিক বিবৃতি’, কখনোসখনো নির্বাচনী ইশতেহারও বলা যায়। ‘অর্থবিল’ লোকচক্ষুর আড়ালেই থেকে যায়, নথিতে তার অবস্থান ‘সংযোজনী’ হিসেবে। বাজেট প্রস্তাব পেশের পর ‘বাজেট আলোচনা’য় অর্থবিলের পর্যালোচনা প্রাসঙ্গিকতা খুব একটা দেখা যায় না।