একুশে ফেব্রুয়ারিতে অনেক বৈশিষ্ট্যের প্রধান দুটি ছিল প্রভাতফেরি ও ছোট ছোট সংকলন। খালি পায়ে গান গাইতে গাইতে রওনা হতো ছেলে-মেয়েরা, খুব সকালে। শহীদ মিনারে আসত। যেত আজিমপুরের গোরস্তানে। এই অভিজ্ঞতা আগে ছিল না, মুসলমান মধ্যবিত্ত গানের ব্যাপারেই উৎসাহহীন ছিল, প্রভাতফেরি তো পরের কথা। সংকলন প্রকাশের ব্যবস্থা ১৯৫২ সালের আগে অমনভাবে দেখা যায়নি। পাড়ার ছেলেরা সংকলন ছাপত, সাংগঠনিকভাবে তা ছাপানো হতো। লেখা সংগ্রহ, ছবি আঁকিয়ে নেওয়া, প্রুফ দেখা, ছাপানো, বাঁধানো এবং যেটা সবচেয়ে জরুরি দল বেঁধে বিক্রি করা—সব কিছুতেই চমৎকার উৎসাহ দেখা যেত। এখন প্রভাতফেরিও কমেছে, সংকলনও আগের মতো নেই।
দুইয়ের মধ্যে মিল ছিল। উভয়েই ছিল স্বতঃস্ফূর্ত, প্রাণবন্ত ও প্রতিবাদী। কেউ বলে দিত না, কিন্তু জানত তরুণরা যে প্রভাতফেরিতে যেতে হবে, গান থাকবে গলায়, ব্যানার থাকবে হাতে, কালো কাপড়ে লেখা ব্যানার শহীদ স্মৃতি অমর হোক, প্রতিষ্ঠানের নাম লেখা ব্যানারও সেই সঙ্গে। জানত তারা যে সংকলন বের করা চাই সময়মতো, একুশ উপলক্ষে। প্রাণ আসত ওই স্বতঃস্ফূর্ত আন্তরিকতা থেকে এবং সব আয়োজনের মধ্যে একটা প্রতিবাদ থাকত, শান্ত অথচ দৃঢ়। প্রতিবাদ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। প্রতিবাদ অন্যায়ের বিরুদ্ধে। একুশে ফেব্রুয়ারির এই উভয় অঙ্গে এখন যে দুর্বলতা তা মোটেই অস্বাভাবিক নয়, খোঁজাখুঁজি না করেও কারণ জানা যাবে। পরিবর্তন এসেছে আত্মগত অবস্থায়, এসেছে বৈষয়িক ব্যবস্থায়ও। বৈষয়িক পরিবর্তনের ব্যাপারটাই প্রথমে লক্ষ করা যাক।
প্রথম সত্য বোধ করি এটি যে একুশে ফেব্রুয়ারি একসময়ে যেমন অনন্য ছিল, এখন আর তেমন নেই। এমন আরো দুটি জাতীয় দিবস পেয়েছি আমরা। ১৬ই ডিসেম্বরে বিজয় দিবস। ২৬শে মার্চে স্বাধীনতা দিবস। একুশে ফেব্রুয়ারির সঙ্গে এদের মিল আছে, এগুলোও স্বাধীনতার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। পহেলা বৈশাখও আছে। তার মূল্যও পড়ে যায়নি।