এই বছরের প্রথম আমার যে লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল, সেখানে ২০২১ সালের জন্য ২১টি চিন্তা জায়গা পেয়েছিল। চিন্তাগুলোর অনেকগুলোই আপাতভাবে সংযোগহীন মনে হলেও তাদের গভীরে অনেক ইন্টার-কানেকটেড বিষয় আছে, যার মাধ্যমে ২১টি বিষয়ই যুক্ত। তার একটি বড় যোগসূত্র হলো অন-ডিমান্ড জীবন।
এটা মোটামুটি সবাই বুঝতে পেরেছেন যে, এই দশকেই এই গ্রহের অনেক কিছু পাল্টে যাবে। জীবন-জীবিকা এবং তার সঙ্গে জীবনযাপন। পৃথিবীর অন্য দেশগুলো যেভাবে পাল্টাবে, তার ছোঁয়া বাংলাদেশের মানুষের ওপরও পড়বে। হয়তো একই মাত্রায় পড়বে না, তবে একদম ছেড়েও যাবে না।
বাংলাদেশে এই পরিবর্তনের ছোঁয়া একটু কম হতে পারে এই জন্য যে, উন্নত দেশগুলো যেভাবে নিজেদের প্রযুক্তিনির্ভর করে ফেলেছে, আমরা এখনো অনেক কিছুতেই বেসিক কাজগুলো করছি। আমরা এখনো মৌলিক অবকাঠামো তৈরি করছি। এগুলো প্রস্তুত করে, তারপর পরবর্তী ধাপে যেতে হবে। যেমন আমরা চাইলেই এই বছর ফাইভ-জি চালু করতে পারি। কিন্তু সেই ফাইভ-জি থেকে চীন বা ইউরোপ যে সুবিধাটা নিতে পারবে, তেমন কিছু করতে হলে আমাদের আরো অনেক প্রস্তুতি লাগবে, যেগুলো সময়সাপেক্ষ বিষয়।
তবে এটা মোটামুটি বোঝা গেছে, মানুষের কাজের পরিধি অনেক ক্ষেত্রেই পাল্টে যাবে। অনেক কাজ অন-ডিমান্ড হয়ে যাবে। চাহিদা অনুযায়ী কাজটা থাকবে। সেভাবেই কাজের সম্মানী দেয়া হবে। এই ধরনের কাজকে আমরা বলছি অন-ডিমান্ড কাজ। অনেক ক্ষেত্রে ফ্রিল্যান্সিং। অনেকেই মনে করছেন, ফ্রিল্যান্সিং কাজের মতো সুখ মনে হয় আর কোথাও নেই। যখন কাজ করব না, নিজের মতো ছুটি কাটাব। বিষয়টি এত সহজ নয়। মানুষকে প্রতিনিয়ত কাজের জন্য ছুটতে হবে, এবং এই কারণেই একজন মানুষ আরো বেশি মেশিনে পরিণত হবে।
আমেরিকাতে যারা আমাজনের পণ্য ডেলিভারি করেন, তাদের বেশিভাগই এখন অন-ডিমান্ড। এবং তাদের জীবন খুবই কষ্টের। জীবনের একটা মূল উদ্দেশ্যই দাঁড়িয়ে যায় সারভাইভ করার জন্য। তার কাছে আর সময় থাকে না জীবনকে জীবন হিসেবে দেখার জন্য। তার কাছে জীবন মানেই জীবিকা। আপনার জীবন ৯০ ভাগ সময়ই যদি চলে যায় জীবিকার জন্য, তখন সেই জীবনের অর্থ খুঁজে পাওয়া কঠিন।
জীবিকার সঙ্গে সঙ্গে জীবনের অন্য বিষয়গুলোও অন-ডিমান্ড হয়ে যাবে কি না, তা নিয়ে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। অনেকেই আমার কাছে সরাসরি প্রশ্ন করেছেন, ‘আমাদের জীবনে প্রেম-ভালোবাসাও কি অন-ডিমান্ড হয়ে যাবে? এটাও কি সম্ভব? চিরন্তন প্রেম বলে কি কিছু থাকবে না? আমি কি একটা মানুষের প্রেমে সারাটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারব না? প্রযুক্তি কি আমার সেই মনের দুয়ারে হানা দেবে?’
২.
প্রযুক্তি কিংবা মেশিন নয়তো রোবট কীভাবে আমাদের প্রভাবিত করবে, সেই আলোচনায় যাওয়ার আগে আসুন দেখে নিই প্রেম-ভালোবাসা বলতে আমরা কী বুঝি! এবং আমাদের ব্রেইনে সেটা কীভাবে কাজ করে।
মানুষ যখন আরেকটি মানুষের প্রেমে পড়ে, তখন কিন্তু সে সবকিছু দেখেশুনে প্রেমে পড়ে না। একজন ব্যক্তির বিশেষ কিছু গুণকে সে এত বেশি পছন্দ করে, কিংবা ওই গুণটি দিয়ে আকৃষ্ট হয় যে সেই মানুষটির অন্য বিষয়গুলোকে মানুষ খেয়াল করে না; কিংবা ব্রেইন সেগুলোকে গণনায় আনে না। ধরুন একটি ছেলে একটি মেয়ের প্রেমে পড়েছে। সে ওই মুহূর্তে ওই মেয়েটির বিশেষ কিছু বিষয় দিয়ে আকৃষ্ট হয়েছে। হয়তো তার চোখ, নয়তো হাসি, নয়তো ব্যবহার, কিংবা অন্য কিছু। সেই আকর্ষণ এতই তীব্র যে, সে তখন মাথায় নেয়নি যে মেয়েটির হাতের নখ ঠিক নেই, মেজাজ মাঝে মাঝে খুবই খিটখিটে, শব্দ করে চা খায় ইত্যাদি।
একই বিষয় উল্টো দিকেও সত্যি। একটি মেয়ে যখন একটি ছেলের প্রেমে পড়ে, তখন ছেলেটির এলোমেলো কবি কবি উশকোখুশকোতাই মেয়েটিকে টেনেছে। তখন খেয়াল করা হয়নি যে, ছেলেটি ভালো করে গুছিয়ে কথা বলতে পারে না, নয়তো হাতের লেখা খারাপ, নয়তো ক্যারিয়ার ভালো না ইত্যাদি।
মূল কথাটা হলো, একটি মানুষ কিছু বিশেষ কারণে প্রেমে পড়ে। বাকিগুলো নিয়ে তখন এত নজরে থাকে না। কিন্তু ধীরে ধীরে সে ওগুলো যখন আবিষ্কার করতে থাকে, তখন তার প্রেমটাও খানিকটা টানহীন হয়ে যায়। কিংবা খুব কাছে যখন তারা আসতে শুরু করে, তখন আরো অনেক খুঁত তাদের চোখের সামনে চলে আসে। তার কিছু কিছু সে মেনে নিতে পারে, কিছু কিছু পারে না। তখন মানসিক টানাপোড়েন চলে। কেউ কেউ সেগুলো মানিয়ে নিয়ে কাটিয়ে দেয় জীবন, কেউ কেউ তা করে না। সে কারণে নানান ধরনের পরিণতি আমরা দেখতে পাই।
এর ভেতর যে এক্সপেশন নেই, তা কিন্তু নয়। আমি মোটাদাগে বেশিভাগ মানুষের কথাগুলো এখানে বলছি। আমরা বাংলাদেশের মানুষ আগে ইউরোপ-আমেরিকার ডিভোর্সের হার দেখে চমকাতাম। একজন মানুষ এতবার কেন বিয়ে করছে, সেটা নিয়ে আমাদের এখানে মুখরোচক গল্প হতো। কিন্তু গত ২০ বছরেই কি বাংলাদেশ একই পথে হাঁটছে না?
ওই যে বলেছিলাম, বাংলাদেশ অন্যান্য দেশ বা সমাজকেই অনুসরণ করে এগোবে। জীবন তো থেমে থাকবে না। এই পরিবর্তনের হারটা কেবল একটু কমবেশি হবে। তবে এখন যা হচ্ছে, প্রযুক্তি এসে সেই পরিবর্তন ত্বরান্বিত করবে, এই যা!
৩.
মানুষ যেহেতু আরেকটি মানুষের সবকিছু পছন্দ করে না, তাই তার পছন্দের নানান বিষয় সে বিভিন্ন মানুষের কাছে পাবে। কার সঙ্গে তার কফি খেতে ভালো লাগবে, কার সঙ্গে লং ড্রাইভে, কারো সঙ্গে বিছানায়, কারো সঙ্গে আড্ডায়! মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই এমন। মানুষ তৈরিই হয়েছে এভাবে। আমরা সেগুলোকে নানান কারণে এক্সারসাইজ করি না হয়তো। নিজের মনকে, কিংবা ব্রেইনকে বলি- না, এটা করা যাবে না। কিন্তু মনের গভীরে সেই চাওয়াটা থাকেই।
মানুষকে সমাজের নানান বিধিনিষেধ দিয়ে এমনভাবে ব্রেইনকে সীমিত করে দেয়া হয়েছে যে, অনেকেই এটা হয়তো ভাবতেও পারেন না। কিংবা মনের ভেতরে এই যে ভাবনাটুকু এল- এটাকেও মনে করেন মহাপাপ। সে জানেই না যে, মন তার অনেক ক্রিয়েটিভ। মনের ভেতর এমন অসংখ্য জিনিস আসবে। কেউ মুচকি মুচকি হাসেন। কিন্তু বেশিভাগ মানুষ সেটাকে পাত্তা দেন না, কিংবা সাহস করে এক্সারসাইজ করেন না। আবার অনেকেই হয়তো করেন। সে কারণে সম্পর্ক ভাঙে, নতুন সম্পর্ক তৈরি হয়! এখন সেই হারটা আরও বেশি!
এই যে একজন মানুষ (নারী-পুরুষ অভিন্ন) আরেকজন মানুষের হাসির প্রেমে পড়ল, সেই হাসি কি সে আর দেখতে চাইবে না? তার কি ইচ্ছে করবে না, প্রতিদিন না হোক মাঝে মাঝে সেই হাসিটা তার সামনে চলে আসুক। তার কি ইচ্ছে করবে না, ওর সঙ্গে দুদণ্ড সময় ব্যয় করি। এই জীবনে সময় দিয়েই তো সব পেতে হয়। একটা বেলা কি তাকে দিতে ইচ্ছে করবে না?
ইচ্ছে ঠিকই করবে। মানুষ যত বেশি উদার হবে, জ্ঞাননির্ভর হবে, আর্থিকভাবে আত্মনির্ভরশীল হবে- তত বেশি স্বাধীন হবে। তত বেশি সে নিজের বিষয়ে সচেতন হবে। তার নিজের চাওয়া-পাওয়া তত শক্তিশালী হবে। তখন সে কারো কারো সঙ্গে কফি খেতে চাইবেই। তার চাওয়া যে পূরণ করবেই।
এই যে চাওয়া, তাকে পাওয়াতে সাহায্য করছে প্রযুক্তি। আগে সেই সুন্দর হাসির মানুষটিকে খুঁজে পেতে তার অনেক সমস্যা হতো। প্রায় অম্ভব হতো। মনে আছে পুরোনো দিনের সিনেমাগুলো? একজনের পা দেখে নায়ক সেই যে প্রেমে পড়ল- তার পেছনেই ছুটে চলা। সেই সময় এখন আর নেই। একজনের পা কাউকে আকৃষ্ট করার সঙ্গে সঙ্গেই, হাজারটা চোখ, হাত, শরীরের পেশি, কারো কার্ভ, কারো গালের টোল- সব এসে হাজির হচ্ছে মুহূর্তেই। তার কাছে অনেক বেশি অপশন চলে আসছে। এবং মানুষ আরও বেশি রেস্টলেস হয়ে পড়ছে।
এই দশক এবং আগামী দশকগুলোতে মানুষ অত্যন্ত ব্যস্ত জীবন কাটাবে। জীবিকার জন্যই মানুষ ছুটতে থাকবে আরও বেশি। এই গ্রহের লোকসংখ্যা যেমন বাড়ছে, মানুষের ভেতর সুযোগ তৈরি হয়েছে বেশি। একইভাবে মানুষ রেস্টলেস হয়েছে আরও বেশি। এবং এই গতি অব্যাহত থাকবে। মানুষের ব্রেইন যেহেতু অনেক বেশি অকোপাইড থাকবে, সে চাইলেও দিনরাত অখণ্ড সময় পাবে না আরেকটি মানুষকে দেয়ার মতো। না পারবে একজন নারী, না পারবে একজন পুরুষ। আগামী দিনগুলোতে নারীরাও অনেক ব্যস্ত হয়ে উঠবেন। তাতে নারী-পুরুষে দূরত্ব কমে আসবে। তার প্রভাব পড়তে থাকবে সম্পর্কের ওপরও।
প্রযুক্তি এমন জায়গায় নিয়ে যাবে আপনাকে, আপনি কোথাও কফি খেতে খেতেই পেয়ে যাবেন আপনার পছন্দের মানুষ। আবার সে হারিয়ে যাবে অন্য কোথাও। আপনিও। মানুষের সম্পর্কগুলো হবে অন-ডিমান্ড, কারণ আপনার জীবনযাপন হবে অন-ডিমান্ড। আপনি হয়তো চাইবেন না, আরেকজন মানুষ সারা দিন আপনার চারপাশে ঘুরঘুর করুক। আপনি চাইবেন, আপনার একান্ত সময়ে কাউকে পেতে যখন আপনার ব্রেইন ফ্রি থাকবে। আপনি আপনার ডিমান্ড অনুযায়ী চলতে চাইবেন, অন্যের ডিমান্ড অনুযায়ী নয়। প্রযুক্তি শুধু এই দুটো ডিমান্ডকে কানেক্ট করে দেবে, যেভাবে ফুড ডেলিভারি করছে কোম্পানিগুলো।
এমনকি এভাবেই হয়তো দুটো মানুষ দীর্ঘ দিন দূরে দূরে থেকেও কাছে থাকবে। তারা তাদের সুবিধামতো একসঙ্গে সময় কাটাবে। আবার যে যার মতো ছুটে বেড়াবে- আবার তারা একত্র হবে। মানুষের ব্রেইন এবং চারপাশ তখন এভাবে অভ্যস্ত হয়ে যাবে। এটা নিয়ে কেউ আর ভাববেই না। এই দেশেই একটা সময় ছিল যখন একটি মেয়ে তার ক্লাসের কারো সঙ্গে রিকশায় উঠলে তার পরিবার কী কঠিন চোখেই না তাকাত। আর এখন? একজন স্বামীও তার স্ত্রীকে তার কলিগের সঙ্গে রিকশায়, এমনকি দেশের বাইরে ট্রাভেলে যেতেও বাধা দেয় না। এটাই এখন বাস্তবতা। আমরা এটাকে সহজভাবে নিয়েছি।
মানুষ দ্রুতই এডাপ্ট করে। আর যারা করে না, তারা ছিটকে পড়ে যায়। এই গ্রহের মানুষ অন-ডিমান্ড সম্পর্কে আরো বেশি ছুটছে। প্রযুক্তি তাতে আরও বেশি সাহায্য করছে। পরের জেনারেশনগুলোর কাছে এটাই স্বাভাবিক ঠেকবে। পেছনের দিকে তাকানোর মতো সময় তো তার কাছে নেই!