স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বরাদ্দ ও ব্যয়ের সংকট কী কাটবে?
প্রকাশিত: ১০ জুন ২০২০, ১৯:৩৫
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই দেশের নাজুক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার চিত্রটি বেরিয়ে এসেছে। একদিকে যেমন মহামারি সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে দেশটির স্বাস্থ্যখাত, সেই সঙ্গে এর নানা দুর্বলতার বিষয়টিও সামনে এসেছে।
জুন মাসে বাংলাদেশে জাতীয় বাজেটের আলোচনায় তাই কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছে স্বাস্থ্য খাত।
অনেকেই স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ আরো বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের অনেকে আবার বলছেন, শুধুমাত্র বরাদ্দ বাড়িয়ে স্বাস্থ্যখাতের নাজুক অবস্থার পরিবর্তন হবে না, এজন্য দরকার বরাদ্দ বাস্তবায়নের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও কার্যকর ব্যবহার।
সেই সঙ্গে বহু বছর ধরেই স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দে অনিয়ম, দুর্নীতি ও অর্থহীন ব্যয়ের অভিযোগও উঠছে। সরকারি স্বাস্থ্যখাতের বেহাল দশার কারণে বাংলাদেশে গড়ে উঠেছে বেসরকারি বিশাল একটি চিকিৎসা সেবা ব্যবস্থা। যেখানে চিকিৎসা সেবা নিয়ে নানা অভিযোগ রয়েছে।
স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ বাংলাদেশের জাতীয় প্রবৃদ্ধির বিবেচনায় অন্যান্য খাতের তুলনায় স্বাস্থ্যখাত বাজেটে বরাবরই কম গুরুত্ব পেয়ে আসছে।
২০১৯-২০২০ সালের চলতি বাজেটে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতের জন্য বরাদ্দ রয়েছে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির মাত্র ০ দশমিক ৮৯ শতাংশ। অর্থ মূল্যে যার পরিমাণ ২৫ হাজার ৭৩৩ কোটি টাকা। পুরো বাজেটের আকারের তুলনায় তা ছিল মাত্র ৫ দশমিক ৮ শতাংশ। অথচ পরিবহন ও যোগাযোগ খাত পেয়েছে বাজেটের ২৬ দশমিক ১ শতাংশ, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন খাত পেয়েছে ১৫ দশমিক ৪ শতাংশ।
আগের বছর ছিল জিডিপির মাত্র শূন্য দশমিক ৯২ শতাংশ। উন্নত দেশগুলোর মধ্যে নিউজিল্যান্ডে ব্যয় করা হয় জিডিপির ৯ শতাংশ।
জাতিসংঘের ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কমিশন ফর এশিয়া অ্যান্ড দ্যা প্যাসিফিকের (এসকাপ) ২০১৮ সালের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জিডিপির বিচারে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ৫২টি দেশের মধ্যে স্বাস্থ্য খাতে সবচেয়ে কম বরাদ্দ দেয়া হয় বাংলাদেশ।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলছেন, ''বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের জন্য এই পরিমাণ খুবই অপ্রতুল। এ খাতে মাথাপিছু বরাদ্দ মাত্র ১ হাজার ৫৩৭ টাকা। এ কারণে মানুষকে নিজের পকেট থেকে প্রায় ৬৬ শতাংশের মতো খরচ করতে হয়। অর্থাৎ স্বাস্থ্যের পেছনে ১০০ টাকা খরচ হলে সরকারি সহায়তা পাওয়া যায় ৩৪ টাকা এবং বাকি ৬৬ টাকা রোগী নিজে বহন করে। এই টাকা খরচ করা অনেক মানুষের জন্য একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।''
চিকিৎসার চেয়ে অবকাঠামো ও ক্রয়ে বড় খরচ স্বাস্থ্য খাতের খরচের বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, একদিকে বাজেটে যেমন বরাদ্দ কম, অন্যদিকে এই বরাদ্দের যতটা না চিকিৎসার পেছনে খরচ হয়, তার চেয়ে বেশি খরচ হয় ভৌত অবকাঠামো, প্রশিক্ষণ ও বেতন-ভাতার পেছনে।
চলতি বছরের মোট বরাদ্দ ২৫ হাজার ৭৩৩ কোটি টাকার মধ্যে ১৩ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকা চলে গেছে পরিচালন খাতে। এর মাত্র এক চতুর্থাংশের মতো বরাদ্দ হচ্ছে ওষুধ ও সরঞ্জাম কেনার পেছনে। বাকি অর্থ চলে যাচ্ছে বেতন-ভাতায়, যদিও প্রয়োজনের তুলনায় এখনো চিকিৎসক ও নার্সের সংখ্যা অনেক কম।
জাতীয় স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের আহবায়ক ডা. রশিদ-ই মাহবুব বলছেন, ''সক্ষমতার অভাব, কিছুটা দুবৃর্ত্তায়ন আছে, একটা সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে যারা এগুলো অপচয় করে -সবকিছু মিলে আমূল সংস্কার দরকার। সংস্কার, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ছাড়া বরাদ্দ বাড়ালেও স্বাস্থ্যখাতে পরিবর্তন আসবে না।'' তিনি বলছেন।
''অবকাঠামো কিছু আছে, কিন্তু সেখানে কাজ হচ্ছে না। রোগীর চাপ অনেক বেশি, কিন্তু তাদের জন্য মানসম্পন্ন চিকিৎসার কোন ব্যবস্থা নেই। রোগীর জন্য যে বরাদ্দ, সেটাও কিন্তু খুবই কম।''
সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে সরকারি হাসপাতাল রয়েছে ৬৫৪টি এবং এসব হাসপাতালে মোট শয্যার সংখ্যা ৫১,৩১৬টি। আর বেসরকারি হাসপাতাল রয়েছে ৫,০৫৫টি, যেখানে মোট শয্যার সংখ্যা ৯০,৫৮৭টি।
বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, দেশে অনুমিত জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৪৬ লাখ।
সেই হিসাবে প্রতি ১,১৫৯ জন ব্যক্তির জন্য হাসপাতালে একটি শয্যা রয়েছে।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলছেন, ''যে বাজেট বরাদ্দ দেয়া হয়, সেটাও পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা হয় না। সেটা মূলত ভৌত অবকাঠামো, প্রশাসনিক ব্যয়, বেতন-ভাতা ইত্যাদিতে চলে যায়। প্রকৃতপক্ষে রোগীর সেবার জন্য বরাদ্দ খুবই কম।
''একদিকে বরাদ্দ কম, অন্যদিকে বাস্তবায়নের হার কম, অন্যদিকে ব্যয়ের গুণগত মান নিশ্চিত করা- এই সমস্যাগুলোর যদি সমাধান না হয়, তাহলে স্বাস্থ্যখাতের যে দৈন্যদশা, তা থেকে আমরা উত্তরণ ঘটাতে পারবো না,'' বলছেন ফাহমিদা খাতুন।