পঙ্গপাল মুহূর্তেই ১০টি হাতির খাবারের সমান ফসল সাবাড় করে!
প্রকাশিত: ২৭ মে ২০২০, ১৫:৩৩
পঙ্গপাল পরিবেশের জন্য বেশ ভয়ঙ্কর! ফসলের ক্ষেতসহ নানা উদ্ভিদ ধ্বংসে পঙ্গপালের হানাই যথেষ্ট। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো, বিভিন্ন মহামারি বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সঙ্গে কোনো না কোনো যোগাযোগ রয়েছে পঙ্গপালের। এই করোনা মহামারি ও ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের সময় তারই নিদর্শন মিলল। অতীতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার লেখায় পঙ্গপালের ক্ষতিকর দিকের বর্ণনা দিয়েছেনে এভাবে- ‘এবার পঙ্গপাল এসে বড়ো ক্ষতি করেছে। ক্ষিতিবাবুর ক্ষেতে একটি ঘাস নেই। অক্ষয়বাবুর বাগানে কপির পাতাগুলো খেয়ে সাঙ্গ করে দিয়েছে। পঙ্গপাল না তাড়াতে পারলে এবার কাজে ভঙ্গ দিতে হবে। ঈশানবাবু ইঙ্গিতে বলেছেন, তিনি কিছু দান করবেন।’
তবে এই পঙ্গপাল আসলে ঠিক কী ধরনের পতঙ্গ? যারা আকাশ অন্ধকার করে ধেয়ে এসে শেষ করে ক্ষেতের ফসল। পঙ্গপাল যদিও কোনো নির্দিষ্ট পতঙ্গ নয়। বহু ধরনের কীট একসঙ্গে দল বেঁধে ঝাঁকে ঝাঁকে আক্রমণ করে। জীবজন্তুদের এই প্রবণতাকে বলে ‘গ্রেগারিয়াস’। এই প্রবণতায় বিচ্ছিন্ন বিভিন্ন ধরনের পতঙ্গ জোটবদ্ধ হয়। সাধারণত খাবারের আকাল দেখা দিলে প্রাণীজগতে এই প্রবণতা দেখা দেয়। এই ধারা মেনেই দল বাঁধে নানা রকমের ফড়িং। তারপর ঝাঁক বেঁধে আক্রমণ করে ফসলের জমিতে। এই ঝাঁককেই বলা হয় পঙ্গপাল। তারা পরিযায়ী কীট। দীর্ঘ দূরত্ব পাড়ি দেয়ার সময় পথে যেটুকু ফসল পায়, সব খেয়ে ফেলে। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো প্রত্যেক পতঙ্গ দৈনিক নিজের ওজনের সমান খাবার খায়। ফলে একটি ঝাঁকের একাংশ এক দিনে যা খায়, তা ১০টি হাতির খাবারের সমান! পঙ্গপালকে ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘লোকস্ট’ এসেছে লাতিন শব্দ ‘লোকস্টা’ থেকে। যার অর্থ ফড়িং। প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার সমাধি থেকে প্রায় সব ধর্মগ্রন্থে পঙ্গপালের উল্লেখ আছে। পঙ্গপালের আক্রমণের জেরে বহু দেশে মানুষ তার বসতি পাল্টাতে বাধ্য হয়েছে। নিজেদের মতো মানুষকেও পরিযায়ী করেছে পঙ্গপাল বাহিনী। পঙ্গপালের আক্রমণের পরেই সে জায়গায় প্লেগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে অতীতে। আবার অন্যদিকে, পঙ্গপালকেও মানুষ নিজের খাদ্য বানিয়েছে। বিশ্বের অনেক দেশেই পঙ্গপাল লোভনীয় খাবার। ২৪৭০ থেকে ২২২০ খ্রিস্টপূর্ব সময়ে মিশরীয়রা তাদের সমাধিতে পঙ্গপালের ছবি আঁকত। প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ এবং ইলিয়ডে পঙ্গপালের উল্লেখ আছে।
পঙ্গপালের আক্রমণের পরে সেই স্থানের অবস্থা শোচনীয় হত বলে বর্ণনা করা হয়েছে সব বিবরণে। গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল এবং রোমান ঐতিহাসিক টাইটাস লিভিয়াস গবেষণা করেছিলেন পঙ্গপালের আচরণের উপর। ২০ শতকের গোড়া থেকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত হয় পঙ্গপালের প্রাদুর্ভাব। সে সময়ে বেশ কিছু উপায়ে নিয়ন্ত্রণ করা হতে থাকে ঝাঁকবদ্ধ এই পতঙ্গদের। জমিতে কীটনাশক ছড়িয়ে, যন্ত্রের সাহায্যে, আগুনের হলকা ছুড়ে, জলাশয়ে ফাঁদ পেতে ধরা হয়েছে পঙ্গপালদের। ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে এর প্রকোপ কমেছে।
তবে কম হলেও পুরোপুরি বন্ধ হয়নি এর আক্রমণ। বর্তমানে রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ, গুজরাত, পঞ্জাব, মধ্যপ্রদেশ-সহ ভারতের বেশ কিছু রাজ্যে হানা দিয়েছে পঙ্গপাল বাহিনী। কৃষিবিজ্ঞানীদের ধারণা, দ্রুত নিয়ন্ত্রণ না করলে পঙ্গপাল বাহিনীর আক্রমণে মধ্যপ্রদেশে শুধু মুগ ডালই নষ্ট হবে অন্তত আট হাজার কোটি টাকার। ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হবে তুলা ও মরিচের চা। গত ২৭ বছরে এত ভয়াবহ পঙ্গপাল বাহিনীর আক্রমণের মুখে পড়েনি দেশ। পঙ্গপালের মধ্যেও বিভিন্নরকম প্রজাতি আছে। তাদের মধ্যে সবথেকে বেশি ক্ষতি করে ‘ডেজার্ট লোকস্ট’। সেই প্রজাতি-ই আফ্রিকা মহাদেশের পূর্ব অংশে ‘হর্ন অব আফ্রিকা’ উপসাগরীয় অঞ্চল থেকে পাড়ি দিয়ে ইরান, পাকিস্তান হয়ে ঢুকছে ভারতে। এসব রাজ্যের কৃষকদের সতর্ক করা হয়েছে।
পঙ্গপালের আক্রমণে আবার অশনি সঙ্কেত দেখছেন চাষিরা। রাজস্থানের ৫০ হাজার হেক্টর জমি এখন পঙ্গপালের কবলে। মধ্যপ্রদেশের ১৬ টি এবং উত্তরপ্রদেশের ১৭ টি জেলায় হানা দিয়েছে পঙ্গপাল। পঙ্গপাল বাহিনী একদিনে ১৩০ কি.মি. অবধি দূরত্ব পাড়ি দিতে পারে। প্রতিটি পতঙ্গ, রোজ ২ গ্রাম অবধি ফসল খেয়ে নিতে পারে, যা তার নিজের ওজনের সমান। ১৯৯৩-এর পরে আবার এক ভয়াবহ পঙ্গপাল-আক্রমণের মুখে ভারত। কতটা ভয়ঙ্কর এই পঙ্গপাল? ১৯৩৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডোতে পঙ্গপালের এক বিশাল স্রোত নির্মূল করতে চলন্ত ট্রেন থেকে আগুন নিক্ষেপ করেছিল সেনাবাহিনী।
তবে তাদের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল। পঙ্গপাল সব বাধা অতিক্রম করে জমির সব ফসল খেয়ে ফেলে। ৮০ বছরের বেশি সময় পার হলেও ভয়ঙ্কর পঙ্গপালের ঝাঁক নিয়ন্ত্রণ করার কোনো কার্যকরী উপায় পাওয়া যায়নি। এরপর ১৯৯৩ সালে ব্যাপক আকারে পঙ্গপালের আক্রমণের মুখে পড়ে পাকিস্তান। এই ধাপে ২০১৯ সালের মার্চে পাকিস্তানে প্রথম পঙ্গপালের আক্রমণ শনাক্ত হয়। পরে এটি সিন্ধু, দক্ষিণ পাঞ্জাব ও খাইবার পাখতুনওয়া প্রদেশের নয় লাখ হেক্টর এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। ক্ষতিগ্রস্ত হয় কোটি কোটি রুপি মূল্যের ফসল ও গাছপালা। সম্প্রতি ভারত-পাকিস্তানের বাইরে সৌদি আরবও পঙ্গপালের আক্রমণের মুখে পড়েছে। স্থানীয় সংবাদমাধ্যম অনুযায়ী, পতঙ্গটির আক্রমণ দেশটির কৃষি খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের জন্য ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করেছে।আফ্রিকায় পরিস্থিতি সামাল দিতে ৭ কোটি ডলারের অনুদান চেয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন।
সংস্থাটির প্রধান মার্ক লোকক বলেন, আফ্রিকায় এই ভয়াবহ পঙ্গপাল উদ্বেগজনক হারে ফসল ধ্বংস করেছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, গত ৭০ বছরের মধ্যে কেনিয়াতে কখনো পঙ্গপালের এত বিশাল ঝাঁক দেখা যায়নি। খালি চোখে ঘাসফড়িংয়ের মতো দেখতে পঙ্গপালের একেকটি ঝাঁক, প্রায় ৪৬০ বর্গ মাইল জমি জুড়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে। হাজারো বছর ধরে এরা টিকে আছে। ব্রিটিশরা আফ্রিকা এবং মধ্য প্রাচ্যে কীটপতঙ্গদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই একটি পঙ্গপাল ইউনিট গঠন করেছিল। ১৯৭৬ সালে নিউইয়র্ক টাইমসের এক সাংবাদিক বলেছিলেন, ‘আকাশ ঢেকে ফেলা’ এবং ‘ফসলের জমি মুছে দেয়া’ পঙ্গপালের ঝাঁক হয়তো উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে নির্মূল করা সম্ভব হতে পারে। তবে এখনো পঙ্গপালের অত্যাচার অব্যাহত রয়েছে। বর্তমানে এই সমস্যার বিরুদ্ধে পূর্বাভাস দেয়া যায়, কখন কোথায় এর প্রকোপ দেখা দিতে পারে।
এ বিষয়ে অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির গ্লোবাল লোকোস্ট ইনিশিয়েটিভের গবেষণা সমন্বয়কারী রিক ওভারসন বলেন, পঙ্গপাল ছোট থাকতেই ধ্বংস করতে হয়। কারণ বড় হলে যখন এগুলোর ডানা শক্তিশালী হয়, তখন আর মারার উপায় থাকে না। তার মতে, এগুলো প্রচুর উড়তে পারে। তারা এক সপ্তাহের মধ্যে এক দেশ থেকে অন্য দেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভবিষ্যতে পঙ্গপালের আক্রমণ আরো তীব্রতর হতে পারে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, পৃথিবীর প্রায় ২০ শতাংশ ভূমি পঙ্গপালের আক্রমণের শিকার হয়। বিশ্বের দরিদ্রতম ৬৫ টিরও বেশি দেশে এর প্রকোপ দেখা যায় এবং বিশ্বের জনসংখ্যার ১০ ভাগের এক ভাগের জীবিকা ক্ষতিগ্রস্থ হয়। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, পঙ্গপাল পুরোপুরি ধ্বংস করা সম্ভব নয়। সর্বোপরি, সম্ভব হলেও সেটি উচিত হবে না। কারণ এটি প্রকৃতির অংশ। এর ফলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে।
বর্তমানে শুধু এগুলো ধ্বংস না করে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হচ্ছে। যদিও পঙ্গপাল প্রচুর ক্ষতি করে, তবুও এগুলো নিয়ন্ত্রণে গবেষণার জন্য তহবিলের অভাব রয়েছে। এর একটি কারণ হলো, পঙ্গপাল কয়েক বছর পর পর হঠাৎ আক্রমণ করে, ফলে অন্যসময় এগুলো নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামানো হয় না। এর চেয়ে বড় কথা, পঙ্গপালের ঝাঁক সাধারণত ধনী দেশগুলোর চেয়ে দরিদ্র দেশে দেখা দেয়। এজন্যই ধনী দেশগুলো পঙ্গপাল নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক গবেষণায় আগ্রহ ও অর্থায়ন করতে তেমন রাজি হয় না।