সমকাল : স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণে ইচ্ছুক ইয়াবাকারবারিরা এখন কক্সবাজারে পুলিশ হেফাজতে এক ধরনের 'সেফহোমে' রয়েছেন। সেখানে অন্তত ৫০ জন জড়ো হয়েছেন এরই মধ্যে। তাদের মধ্যে সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদির তিন ভাইসহ টেকনাফের তালিকাভুক্ত ইয়াবাকারবারি রয়েছেন অন্তত ৩০ জন। আত্মসমর্পণে ইচ্ছুকদের এই তালিকা আরও বাড়তে পারে। সংশ্নিষ্ট একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র থেকে গতকাল এসব তথ্য পাওয়া গেছে। ইয়াবাকারবারিদের আত্মসমর্পণের উদ্যোগ নিয়ে এরই মধ্যে অনেক দূর এগিয়েছে সরকার। যারা আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে স্বেচ্ছায় পুলিশের কাছে এসেছেন, তারা সবাই তাদের অতীত কর্মকাণ্ডের জন্য দোষ স্বীকার করে নিয়েছেন। কীভাবে তারা ইয়াবা কারবারে জড়িয়েছেন, জীবনের সেই কালো অধ্যায়ের গল্প শোনাচ্ছেন পুলিশকে। ইয়াবার বাহক থেকে গডফাদার হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন কীভাবে, অনেকে সেই তথ্যও জানিয়েছেন। চলতি মাসের শেষের দিকে ইয়াবা কারবারিদের আত্মসমর্পণের দিনক্ষণ প্রাথমিকভাবে ঠিকঠাক থাকলেও আপাতত পেছানো হতে পারে তা। আগামী ৪ ফেব্রুয়ারি শুরু হচ্ছে 'পুলিশ সপ্তাহ'। এটি ঘিরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা ব্যতিব্যস্ত থাকবেন। তাই আত্মসমর্পণ কার্যক্রম পিছিয়ে আগামী মাসের মাঝামাঝি বা শেষদিকে হতে পারে। সর্বশেষ গত রোববার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, শুধু অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেই যে তারা ভালো হয়ে যাবে, তা নয়। বরং সমাজে তাদের সুষ্ঠু জীবনে ফিরিয়ে আনতে পারাটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। যারা সুস্থ জীবনে ফিরতে চায়, তাদের জন্য সেই সুযোগও সৃষ্টি করতে হবে। এ ব্যাপারে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন বলেন, 'ইয়াবা কারবারিদের জোরপূর্বক আত্মসমর্পণ করানো হচ্ছে না। অনেক ইয়াবা কারবারি আত্মসমর্পণের জন্য এরই মধ্যে পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। প্রকৃত অর্থে যারা ইয়াবা কারবারি, আত্মসমর্পণের জন্য তাদের তালিকা তৈরি হচ্ছে। তাদের ব্যাপারে নানাভাবে যাচাই-বাছাই চলবে। এরপরই আত্মসমর্পণের সুযোগ পাবে তারা।' এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পুলিশের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, আত্মসমর্পণের প্রথম ধাপে তারা টেকনাফকেন্দ্রিক ইয়াবা কারবারিদের অগ্রাধিকার দিতে চান। কারণ টেকনাফ হলো ইয়াবার 'সদর দরজা'। সেখানকার কারবারিরা আত্মসমর্পণ করলে ইয়াবা কেনাবেচা কমবে। এটা দেশের অন্য এলাকার ইয়াবা কারবারিদের জন্য একটা বার্তা হিসেবে দেখা দেবে। আত্মসমর্পণের উদ্যোগ নেওয়ার পর থেকে মিয়ানমার থেকে ইয়াবা চালান আসার সংখ্যা কমছে বলে জানান পুলিশ-র্যাবের কর্মকর্তারা। সংশ্নিষ্ট এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, এরই মধ্যে বিদেশে পলাতক অনেক ইয়াবা কারবারি আত্মসমর্পণ করতে দেশে ফিরেছেন। ভারত, মিয়ানমার, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরবে পলাতক ইয়াবা কারবারিরা দেশে ফেরত এসে পুলিশ হেফাজতে স্বেচ্ছায় চলে গিয়েছেন। ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘোষণা দিয়ে আত্মসমর্পণের জন্য পুলিশ হেফাজতে গেছেন অনেকে। আত্মসমর্পণের জন্য বাড়ি ছাড়ার আগে কোনো কোনো ইয়াবা কারবারিকে তাদের পরিবারের সদস্যরা 'আয়োজন' করে 'বিদায়' জানান। ইয়াবা কারবারিদের আত্মসমর্পণ নিয়ে গত ১৪ জানুয়ারি 'কী হবে মাদকের গডফাদারদের :ইয়াবা ব্যবসায়ীদের আত্মসমর্পণের উদ্যোগ' শিরোনামে প্রথম পাতায় বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশের পর বিষয়টি নিয়ে নানামুখী আলোচনার সূত্রপাত হয়। অত্যন্ত স্বচ্ছতার সঙ্গে আত্মসমর্পণকারীদের তালিকা তৈরি ও এই প্রক্রিয়ায় যাতে রাঘববোয়ালরা ছাড় না পায়, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকার গুরুত্ব দেন অনেকে। কক্সবাজার জেলা গোয়েন্দা পুলিশের সর্বশেষ করা ইয়াবা ব্যবসায়ীর ১ হাজার ১৫১ জনের তালিকায় ৭৩ জন প্রভাবশালী ইয়াবা কারবারিকে (গডফাদার) চিহ্নিত করা হয়েছে। তালিকায় সাবেক সাংসদ আব্দুর রহমান বদিসহ ৩৪ জন সাবেক ও বর্তমান জনপ্রতিনিধি এবং বদির ৫ ভাই আবদুস শুক্কুর, আবদুল আমিন, মৌলভী মুজিবুর রহমান, মো. সফিক ও মো. ফয়সাল ও ১ বোনসহ ২৬ জন নিকটাত্মীয়ের নাম রয়েছে। দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, এরই মধ্যে বদির তিন ভাই আত্মসমর্পণের জন্য পুলিশ হেফাজতে রয়েছেন। তবে কোন তিনজন আত্মসমর্পণের জন্য 'সেফহোমে' এসেছেন তাদের নাম জানাতে রাজি হননি ওই সূত্রটি। এখনও কোনো নারী ইয়াবা কারবারি আত্মসমর্পণের জন্য যোগাযোগ করেননি বলে জানা গেছে। যারা আত্মসমর্পণের জন্য পুলিশ হেফাজতে রয়েছেন তাদের খাওয়া-দাওয়ার খরচ বহন করছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এদিকে সম্প্রতি ইয়াবা কারবারিদের আত্মসমর্পণ করার আহ্বান জানিয়েছেন সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুর রহমান বদি। তিনি বলেন, 'ছেলেহারা মা-বাবা, স্বামীহারা স্ত্রী ও বাবাহারা সন্তানদের কথা চিন্তা করে আপনারা আত্মসমর্পণ করার জন্য প্রস্তুত থাকেন। তালিকাভুক্ত এবং তালিকার বাইরে যেসব ইয়াবা কারবারি রয়েছেন, সবাই আত্মসমর্পণ করুন। ইয়াবা টেকনাফবাসীর জন্য অভিশাপ।' গত বছরের ৪ মে থেকে মাদকের বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান শুরু করে র্যাব। ১৮ মে থেকে অভিযানে নামে পুলিশ। পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী অভিযান শুরুর পর এখন পর্যন্ত মাদক সংক্রান্ত মামলা হয়েছে ১ লাখ ১২ হাজার ৫৫২টি। গ্রেফতার হয়েছে ১ লাখ ৪৭ হাজার ৮০৩ জন। ২০১৮ সালে সব সংস্থার হাতে জব্দ হয় ৩ কোটি ৪৯ লাখ ইয়াবা। অভিযানে নিহত হয়েছে চার শতাধিক। অভিযান শুরুর পর প্রায় প্রতিদিনই 'বন্দুকযুদ্ধে' সন্দেহভাজন মাদক কারবারিদের হতাহতের ঘটনা ঘটছে। এ সময় 'বন্দুকযুদ্ধে' শুধু কক্সবাজারেই ৩৭ জন নিহত হয়েছে। এর মধ্যে টেকনাফে নিহত হয় ৩৪ জন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে আওয়ামী লীগের ইশতেহারে মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করা হয়। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্বশীল কর্মকর্তারাও বলছেন, নতুন বছরে মাদক নির্মূল করাই হবে তাদের প্রধান কাজ। এতে কাউকে বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া হবে না। নতুন বছরে মাদকবিরোধী অভিযান আরও জোরদার হবে। তবে মাদকবিরোধী অভিযানে তারা 'হার্ড ও সফট' অ্যাপ্রোচ নিয়ে এগোবেন। আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়াটি সফট অ্যাপ্রোচের অংশ।