নির্বাচিত ছাত্র সংসদ তুলে দিয়ে অরাজনৈতিক ছাত্র কাউন্সিলের বন্দোবস্ত করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকার। দু’বছর আগে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ছাত্র সংসদ নির্বাচন ঘিরে বিভিন্ন কলেজে অশান্তির প্রেক্ষিতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন, সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের মডেলে অরাজনৈতিক ছাত্র কাউন্সিল গঠন করা হবে। পরে বিধানসভায় বিল এনে অরাজনৈতিক ছাত্র কাউন্সিলের সিদ্ধান্তও নিয়েছিল রাজ্য সরকার। তখনই প্রবল সোরগোল উঠেছিল বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের পক্ষ থেকে। অভিযোগ ছিল, ছাত্র ইউনিয়নগুলিকে রাজনীতির প্রভাবমুক্ত করতেই এটা ভাবা হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় এই ছাত্র ইউনিয়ন নির্বাচনকে শক্তির অপচয় বলেও বর্ণনা করেছিলেন। অথচ সব রাজনৈতিক দলেরই ছাত্র সংগঠন রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে এই সব ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্বে নানা আন্দোলনও হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে ছাত্র আন্দোলনের দীর্ঘ ঐতিহ্যও রয়েছে। এই ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়েই উঠে এসেছেন অনেক প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক নেতা। এমনকি ছাত্র আন্দোলন থেকে উঠে এসেছিলেন সাবেক মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যও। মার্কসবাদী কমিউনিষ্ট পার্টির ছাত্র সংগঠন এসএফআইয়ের প্রেসিডেন্ট মধুজা সেনরায় বলেন, আঠারো বছর বয়স হয়ে গেলে আমরা যদি ভোট দিতে পারি তাহলে কলেজে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা প্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারবো না কেন। অরাজনৈতিক বলে কিছু হয় না, এটাই সব ছাত্র সংগঠনের তরফে বারে বারে বলা হয়েছে। আর এর ফলেই দু’বছর পরে ঘুম ভেঙ্গে জেগে উঠে ছাত্র ইউনিয়ন নিয়ে কি করা হবে তা নিয়ে মত জানতে সব ছাত্র সংগঠনকে ডেকে আলোচনায় বসেছিলেন শিক্ষামন্ত্রী। এই বৈঠকে সব ছাত্র সংগঠনই নির্বাচিত ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষেই সওয়াল করেছে। এমনকি, শিক্ষামন্ত্রীর নিজের দল তৃণমূল কংগ্রেসের ছাত্র সংগঠন টিএমসিপি-ও অন্য সংগঠনের সঙ্গে সুর মিলিয়ে জানিয়ে দিয়েছে, চাই ছাত্র নির্বাচন, চাই নির্বাচিত ছাত্র ইউনিয়নই। প্রেসিডেন্সি ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাও নির্বাচনের পক্ষে মত জানিয়ে বলেছে, কাউন্সিল তৈরি করলে ছাত্রছাত্রীদের ভূমিকা অনেকটাই ক্ষুন্ন হবে। তবে টিএমসিপি-র ছাত্র ইউনিয়ন নির্বাচনের পক্ষে সওয়াল করা নিয়ে কিছুটা বিস্ময়ের সৃষ্টি হয়েছে। অবশ্য টিএমসিপি-র পক্ষ থেকে শিক্ষামন্ত্রীকে জানানো হয়েছে, সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের মত নির্বাচিত ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষেই। সরকারের দোলাচলের ফলেই প্রায় আড়াই বছর ধরে রাজ্যে ছাত্রভোট হয়নি। স্বভাবতই সব ছাত্র সংগঠন অবিলম্বে ছাত্রভোটের দাবি জানিয়েছে। শেষ পর্যন্ত পুরনো মত পাল্টে শিক্ষামন্ত্রীও বলেছেন, তিনিও ছাত্রভোট করতে আগ্রহী। তবে যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে কলেজ আছে আর যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে কলেজ নেই, সব ক্ষেত্রে ছাত্রভোট একইভাবে হবে কি না, সেই বিষয়ে ভাবনা-চিন্তা চলছে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে আলাদাভাবে তিনটি ফ্যাকাল্টির ছাত্র সংসদ তৈরি হয়। এ ক্ষেত্রে তিনটি ছাত্র সংসদ থাকবে, নাকি একটি হবে, সেটাও ভাবা হচ্ছে। তবে এখনই ছাত্র নির্বাচন হচ্ছে না জানিয়ে বিষয়টি আপাতত ঝুলিয়েই রাখা হলো বলে পর্যবেক্ষদের অভিমত। রবীন্দ্র সদন-নন্দন ঘিরে সাংস্কৃতিক কেন্দ্রকলকাতার কেন্দ্রে রবীন্দ্রসদন-নন্দন চত্বরে গোটা বছর ধরে চলে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। কলকাতায় ঘুরতে আসা সংস্কৃতিমনস্ক মানুষ এক পাক ঘুরে যান রবীন্দ্র সদন, নন্দন, বাংলা একাডেমি, শিশির মঞ্চ ও কলকাতা তথ্যকেন্দ্র ঘিরে থাকা এই চত্বর। নানা ধরণের মানুষের মেলা থাকে প্রতিদিন বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত। কবি, গায়ক থেকে সব ধরণের শিল্পী সাহিত্যিকদের আনাগোনা ও আলাপচারিতায় গোটা এলাকা প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। আর এজন্যই কলকাতায় আসা অনেক দেশি বিদেশি সেলিব্রিটি বলে থাকেন, কলকাতার প্রাণ উপলব্ধি করতে হলে এই চত্বরে ঢুঁ মারতেই হবে। এবার সেই চত্বরকেই নবরূপে বিশ্বমানে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে বাংলার কৃষ্টি ও সংস্কৃতির আবহকে বজায় রেখেই এই কাজ করতে হবে। উদ্দেশ্য হল, এই চত্বরকে দেশের সংস্কৃতি চর্চার অন্যতম গন্তব্য করে তোলা। যাতে এই চত্বরে পা রাখলেই বাংলার সমাজ, শিল্প, সাহিত্য সংস্কৃতি পলকে চোখের সামনে ভেসে ওঠে। পরিকাঠামোগতভাবে আন্তর্জাতিক রূপ দিতে দেশের প্রথম সারির স্থপতিদের কাছ থেকে প্রস্তাব চেয়ে পাঠানো হয়েছে। সেই সব প্রস্তাব নিয়ে প্রতিযোগিতা হবে। সেরা স্থাপত্য প্রস্তাবকে দেওয়া হবে ৫ লক্ষ রুপির আর্থিক পুরস্কার। ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকটি খ্যাতনামা স্থপতি প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। ভাবনা চিন্তা চলছে এখন যেখানে বইঘর রয়েছে, সেখানে চারতলা একটি ভবন নির্মাণ করা হবে। তবে এলাকার হেরিটেজ ঐতিহ্য বজায় রেখেই। প্রথম ধাপে বাড়িটি হবে দোতলা। দোতলায় থাকবে কাফেটেরিয়া। এই চত্বরে আসা মানুষজন কাচে ঘেরা কাফেটেরিয়ায় বসে কফি খেতে খেতে দু’পাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন। নিচে বইঘর, শিশু-কিশোর আকাদেমিসহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থার বই বিক্রির কেন্দ্র থাকবে। থাকবে লাইব্রেরি ও রিডিং রুম। এছাড়াও তৈরি হবে পর্যটন তথ্যকেন্দ্র। এই কিয়স্ক থেকে এ রাজ্যের পর্যটন সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাবে। এলাকা সৌন্দর্যায়নের কাজ পুজোর আগেই সম্পূর্ণ হবে। সুরের যাদুতে সজ্ঞানে অপারেশনসুরের যাদুতে চলছে সজ্ঞানে অপারেশন। রোগীর শরীরে চিকিৎসকের হাতের স্কালপেল চলছে ব্যস্ততার সঙ্গে। চলছে কাটাছেঁড়া। কিন্তু রোগীর কোনও বিকার নেই। তিনি তখন মগ্ন গানের সুরে। এমনকি নিজে গেয়ে চলেছেন রবি ঠাকুরের গান। অ্যানাস্থেশিয়াকে দূরে সরিয়ে রেখে স্থানীয়ভাবে অবশ করে সুরের যাদুতে অপারেশনের সাফল্য দেখিয়ে নজর কেড়েছেন কলকাতার এক চিকিৎসক। মিউজিক থেরাপিতে চিকিৎসা বিভিন্ন দেশেই এখন গুরুত্ব পাচ্ছে। তবে অস্থিশল্য চিকিৎসক সুমন্ত ঠাকুর সুরের যাদুকে অ্যানাস্থেশিয়ার বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করছেন। তবে তিনি জানিয়েছেন, ব্যাপারটা এমন নয় যে, আচমকা গান বাজাতে শুরু করলাম, আর অ্যানাস্থেশিয়া ছাড়া অপারেশন করে ফেললাম। তার কথায়, প্রথাগত ওষুধের পাশাপাশি রোগীর কাউন্সেলিং খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর রোগীকেও গান ভালবাসতে হবে। তবেই সুরের যাদুতে অপারেশন করা সম্ভব। ডা. ঠাকুর ব্যখ্যা করে বলেছেন, আসলে গানের সুরের পাশাপাশি রোগী যখন নিজে গান গাইতে শুরু করেন তখন তার শরীরে হরমোন ক্ষরণের ধারাটি এমন গতিতে হয় যে, অ্যানাস্থেশিয়ার প্রয়োজন পড়ে না। শুধু অপারেশনের জায়গাটি অবশ করলেই চলে। সেইসঙ্গে তিরি আরও জানিয়েছেন গান বাছাই করাটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। বাছাই করতে হয় মধ্য মাত্রার উদ্দীপক ও ইতিবাচক সুরের গান বা সুর। বেহালা, সরোদ, গিটারের মত যন্ত্রের সুর খুব ভাল কাজ করে। শব্দ মাত্রা থাকতে হবে ৪৮-৬৮ ডেসিবেলের মধ্যে। আর এসবের সমন্বয়েই অপারেশনে কাজ সারা হয়ে যায়। তিনি আরও জানিয়েছেন, এই পদ্ধতির ফলে এড়ানো যায় মাথাব্যথা, গা বমিভাব, রক্তচাপের তারতম্যের মতো অ্যানাস্থেশিয়া সংক্রান্ত জটিলতা। ড. ঠাকুর শতাধিক অপারেশন করেছেন এই সুরের যাদু প্রয়োগ করে। গত ৫ বছর ধরে চলা তার এই সাফল্যের স্বীকৃতিতে শনিবার কলকাতা প্রেসক্লাবে আন্তর্জাতিক ইউনিভার্সাল রেকর্ড ফোরামের পক্ষ থেকে ডা. ঠাকুরের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে ইউআরএফ গ্লোবাল এশিয়ান এন্ড ইন্ডিয়ান পুরস্কার।হেরিটেজ দেব সাহিত্য কুটির কলকাতার বইপাড়া বলে পরিচিত কলেজস্ট্রিট এলাকার ঝামাপুকুর লেনে সগৌরবে মাথা উচুঁ করে দীর্ঘ নব্বই বছর ধরে প্রকাশনা চালিয়ে যাচ্ছে দেব সাহিত্য কুটির। হাঁদাভোঁদা, বাটুল দি গ্রেট, ছবিতে রামায়ণ, মহাভারত এবং গোলাপি মলাটের বর্ণপরিচয় বেরিয়েছিল এই প্রতিষ্ঠান থেকেই। এখনও বেরোয়। বেরোয় দুটি জনপ্রিয় পত্রিকা এবং অসংখ্য নানা ধরণের বই। শিশু ও কিশোরদের জন্য উৎসব সংকলন প্রকাশের কৃতিত্ব এদেরই। ১৯২৮ সালে আশুতোষ দেব তৈরি করেছিলেন এই প্রকাশনা সংস্থাটি। আর মাত্র ১০ বছর পরেই শতবর্ষ পালন করবে বইপাড়ার এই অন্যতম প্রাচীন প্রতিষ্ঠানটি। ২১ নম্বর ঝামাপুকুর লেনে দেব সাহিত্য কুটিরের বাড়ি। গোলাপি রঙের সাবেকি বাড়ি। উত্তর কলকাতার প্রথা মেনে সামনে লম্বা টানা রক। সবুজ রঙের খড়খড়ি আর দরজা। এই বাড়িতেই এক সময় নিয়মিত আনাগোনা ছিল বাংলা সাহিত্যের স্বর্ণযুগের খ্যাতনামা লেখক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ ব্যক্তিদের। এই বাড়িতেই নিজস্ব প্রেস। জমিদার বরদাপ্রসাদ মজুমদারের হাতে বীজ বপন হয়েছিল দেব সাহিত্য কুটিরের। ১৮৬০ সালের আগেই তৈরি করেছিলেন প্রেস। তবে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়েছিল অনেক পরে ১৯২৮ সালে পুত্র আশুতোষের হাতে। আশুতোষ দেবের অভিধান খুব জনপ্রিয় ছিল সে সময়ে। তবে ঝামাপুকুরের এই ঐতিহ্যসম্পন্ন বাড়িটি প্রমোটারের থাবায় ধ্বংস হয়ে যাবার আগেই দেব সাহিত্য কুটিরের স্বত্বাধিকারিদের আবেদনের ভিত্তিতে পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশন ঝামাপুকুরের বাড়ি ও প্রেসটিকে হেরিটেজ মর্যাদা দেবার বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে। গত ২১ আগষ্টই এই বিজ্ঞপ্তি জারি হয়েছে। কমিশনের চেয়ারম্যান শিল্পী শুভাপ্রসন্ন কমিশন জানিয়েছেন, রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রমোটারের থাবা থেকে রক্ষা করতেই হেরিটেজ সিলমোহর দেবার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তাছাড়া এর ফলে সম্পত্তি বিক্রি বা অদলবদল করা যাবে না। লাগানো যাবে না পোষ্টার। কোনও ভাবেই বিকৃতি ঘটানো চলবে না। হেরিটেজ কমিশনের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন সাংস্কৃতিক জগতের সকলে। ঐতিহ্য রক্ষায় এগিয়ে আসার জন্য হেরিটেজ কমিশনকে ধন্যবাদও জানিয়েছেন অনেকে।