ওপার বাংলার উপস্থাপক ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ এখন বাংলাদেশে বেশ আলোচিত নাম। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সুবাদে আমাদের মুঠোফোনে তাঁর অবাধ দাপাদাপি। দেখে অবশ্য বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে মূলধারার গণমাধ্যমে এ ধরনের উদ্ভট কল্পনাবিলাস সম্ভব। কখনো তিনি চট্টগ্রামকে কেটে ভারতে নিয়ে যাচ্ছেন, কখনো বাংলাদেশে নির্বিচার সংখ্যালঘুদের নিয়ে বানোয়াট গল্প সাজাচ্ছেন।
ময়ূখ রঞ্জন অবশ্য এখানে প্রতীকমাত্র। ভারতজুড়ে মূলধারার গণমাধ্যমের অনেকগুলোর অবস্থাই এ রকম। আসামের এক টিভি চ্যানেল দেখলাম বাংলাদেশকে মাঝবরাবর দুই ভাগ করে আর্ধেকের নিয়ে নতুন রাষ্ট্রের ছকও এঁটে ফেলেছে। ব্যতিক্রম যে নেই তা–ও নয়। সাংবাদিক অর্ক ভাদুড়ি থেকে শিল্পী কবীর সুমন পর্যন্ত ওপার বাংলার অনেকেই এই মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলছেন।
এগুলো শুধু গণমাধ্যমের প্রচারে সীমাবদ্ধ থাকলে হয়তো নেহাত বিনোদন হিসেবে নেওয়া চলত। এ উত্তেজনা মুঠোফোনের পর্দা ছাপিয়ে ছড়িয়েছে কলকাতা থেকে আগরতলা পর্যন্ত। আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে ন্যক্কারজনক হামলা হয়েছে। ভারত সরকারের তরফে বাংলাদেশের কূটনীতিক স্থাপনা রক্ষায় এই নজিরবিহীন ব্যর্থতা উত্তেজনার পারদে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
জুলাই অভ্যুত্থানের পর থেকেই ভারতের আচরণ দেখে মনে হয়েছে, বাংলাদেশের জনগণের এই সহসা জেগে ওঠা ভারতের বিজেপি সরকার মেনে নিতে পারেনি। গোড়া থেকেই ভারতের গণমাধ্যম বলার চেষ্টা করেছে, এই অভ্যুত্থান এ দেশে কট্টর ইসলামপন্থীদের উত্থানমাত্র। জুলাইয়ে এ দেশের আপামর জনসাধারণের পথে নেমে আসার কারণ তারা বুঝেও না বোঝার ভান করছে।
চিত্রশিল্পী দেবাশীষ ভট্টাচার্যের একটা কার্টুনে ভারতের এখনকার অবস্থান চমৎকারভাবে উঠে এসেছে। তাতে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ছবির সঙ্গে জুড়ে দেওয়া ইংরেজি মন্তব্যের বাংলা করলে দাঁড়ায়: ‘উপনিবেশ হারিয়ে ফেলেছেন, এমন আচরণ বন্ধ করুন।’
কিন্তু সে আচরণ বন্ধ করার লক্ষণ ভারত সরকার কিংবা সে দেশের গণমাধ্যমে খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। বিস্তর অপতথ্য ভেসে আসছে সীমানা পেরিয়ে। লাগাতার ঘৃণা ছড়ানো হচ্ছে। তাতে সীমান্তের দুই পাশের মানুষ যে একেবারে শান্ত হয়ে আছে, তা বলার উপায় নেই।
ইসকনের বহিষ্কৃত ধর্মগুরু চিন্ময় কৃষ্ণের গ্রেপ্তারকে কেন্দ্র করে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের হাতে জীবন হারিয়েছেন আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ। তাঁর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সহিংসতার আশঙ্কা ছিল ষোলো আনা। কিন্তু সে সময় বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে ধর্মীয় নেতারা, সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। সবার চেষ্টায় রক্তপাত এড়ানো গেছে।
তারপরও হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা একেবারেই হচ্ছে না, তা নয়। তেমনই একটি ঘটনা সম্প্রতি ঘটে সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলায়। জাতীয় নাগরিক কমিটির প্রতিনিধিদলের হয়ে সেখানে গিয়েছিলাম আমরা। সেখানে স্থানীয় এক হিন্দু কিশোরকে গ্রেপ্তার করা হয় পবিত্র কোরআন অবমাননার অভিযোগে। যথানিয়মে এই কিশোরের বিচারের ব্যাপারে আশ্বস্ত করা হয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে।
সেখানেই উত্তেজনার প্রশমন হওয়া স্বাভাবিক ছিল, কিন্তু সন্ধ্যার পর একদল মানুষ সংঘবদ্ধভাবে স্থানীয় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ১৫ থেকে ২০টি বাড়িতে হামলা চালান। সেই গ্রামের বাসিন্দারা প্রাণভয়ে আশ্রয় নেন পাশের জঙ্গলে। নিজ বাড়ি রক্ষা করতে গিয়ে আহত হন একজন। আক্রান্ত ব্যক্তিরা বলছেন, হামলাকারীরা তাঁদের গ্রামের কেউ নন। তাঁরা আমাদের এ–ও বলেছেন, তাঁদের বাজারের মসজিদের ইমাম ও একজন স্থানীয় মৌলভি এগিয়ে এসেছিলেন তাঁদের বাঁচাতে।
মনে প্রশ্ন জেগেছে, ধর্ম অবমাননার ঘটনায় গ্রেপ্তার ও আইনগত প্রক্রিয়া শুরু পরেও কেন উত্তেজনার প্রশমন হয়নি? আশপাশের গ্রাম থেকে কারা লোকজন জড়ো করে এনেছে? স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে এটা মনে হয়নি যে এত মানুষ এমনি এমনি হঠাৎ একসঙ্গে এই গ্রামে এসে পড়েছেন। প্রশ্ন জেগেছে, যাঁরা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে বলে উত্তেজিত হয়ে এই কাণ্ড করেছেন বলে বলা হচ্ছে, তাঁরা লুটপাট করলেন কেন? শুধু ইসলাম কেন, কোনো ধর্মই কি মানুষের বাসস্থানে হামলা করা কিংবা লুটপাট করার কথা বলে?