মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সম্পর্কে প্রথমে যেটা মনে আসবে সেটা হলো, তিনি কিন্তু ‘জাতিবাদী নেতা’ নন। যে অর্থে শেখ মুজিবুর রহমান ‘জাতিবাদী নেতা’, ভাসানী কিন্তু তেমন ছিলেন না। প্রথমত তিনি একজন আন্তর্জাতিকতাবাদী। বিভিন্ন দিক থেকে আন্তর্জাতিক ছিলেন।
এখন প্রশ্ন আসে কোন দিক থেকে আন্তর্জাতিক ছিলেন? তিনি জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের পক্ষে লড়েছেন। সেটা করেছেন পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার কাছে যারা শ্রমশক্তি বিক্রি করে পুঁজির নাটবল্টু হয়ে বেঁচে থাকে তাদের পক্ষে; তারা কৃষক, শ্রমিক, সর্বহারা শ্রেণী, ইত্যাদি। পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থার দ্বন্দ্বও এই গোড়ার বৈষম্যহীনতার বিরুদ্ধে, অর্থাৎ সেই আর্থ-সামাজিক সম্পর্কের বিরুদ্ধে যার ফলে একদিকে উৎপাদনের উপায়, টেকনলজি ও সভ্যতার ফসল অল্প কিছু পরিবার বা কোম্পানির কুক্ষিগত হয় আর বাকি দুনিয়ার মানুষ তাদের গোলামি করে। এই গোলামির জিঞ্জির ভাঙবার জন্য বিশ্বব্যাপী যে লড়াই চলছে মওলানা তাদের রাজনৈতিক এবং আধ্যাত্মিক গুরু। বামপন্থার মধ্যে আধ্যাত্মিকতা বা রুহানিয়াতের কোন প্রেরণা ছিল না। মার্কস পরবর্তী যে সকল বৈপ্লবিক চেষ্টা হয়েছে তাদের ব্যর্থতার কারণ মানুষ স্পিরিচুয়াল বা রুহানি গুণ সম্পন্ন জীব সেই বাস্তবতা অস্বীকার করা। রাজনৈতিক কর্তাসত্তাকে বস্তুজগতের ক্যাটাগরি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না, দেশকালপাত্রের বিধিবদ্ধ বস্তুগত জীবনের বাইরেও মানুষ রুহানি প্রেরণায় ইতিহাসে ভূমিকা রাখতে পারে ইসলাম থেকে— বিশেষত নবী-রসুল-অলি-আউলিয়া-পীর-মুর্শিদের জীবনী থেকে তিনি সেই শিক্ষা নিয়েছিলেন। মওলানা আজাদ সুবহানি তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। শেষ জীবনে ভাসানী নতুন ভাবে রাজনৈতিক লড়াই-সংগ্রামের নতুন রুহানি নীতি ও কৌশল হাজির করেছিলেন। ইত্যাদি নানান কারনে তাঁর দর্শন ও রাজনীতির তাৎপর্য আন্তর্জাতিক। তিনি জাতীয় নেতা নন, আন্তর্জাতিক তো বটেই, তদুপরি অনাগত বিশ্বেরও নেতা।
তিনি যে রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলেন, তাঁর যে রাষ্ট্র চিন্তা, তাঁর যে সমাজ চিন্তা, সেটা অত্যন্ত মৌলিক। আমাদের সবার আগে বুঝতে হবে, ভাসানী সম্পর্কে আমরা যখন আলোচনা করি, তখন খণ্ডিতভাবে করি। আমাদের সমাজে তাঁর সম্পর্কে দুটো ভাগ লক্ষ্য করি– একটা ভাগে আছে, তথাকথিত বামপন্থীরা। এই বামরা বোঝাতে চায়, ভাসানী মাত্রই একজন বাম– একজন লাল। ফলে তাদের তরফে আমাদের একজন ‘লাল ভাসানী’ আছে। সেই ‘লাল ভাসানী’র বয়ানও আছে, ‘লাল ভাসানী’ নিয়ে লেখালেখিও আছে যথেষ্ট।
অন্য যে ধারাটি আছে, সেই ধারার সঙ্গে আমাদের শিক্ষিতমহল পুরোটা পরিচিত নন। দ্বিতীয় ধারার ভাসানী হচ্ছেন ‘সবুজ ভাসানী’, যাদেরকে আমরা পীর বলি। আমরা অনেকে হয়তো জানি না ভাসানী কিন্তু পীরও ছিলেন, তাঁর মুরিদের সংখ্যাও কিন্তু অসংখ্য। এই যে পীর এবং পীরের জীবন, সেই ভাসানীর জীবন অত্যন্ত বিনয়ী, বিনীত একটা জীবন। ইহলৌকিক কামনা, বাসনা, মোহ ও স্বার্থের উর্ধ্বে থেকে এক অসাধারণ জীবন ভাসানী চর্চা করে গেছেন। ফলে তাঁর বিপুল সংখ্যক মুরিদ রয়েছেন। এ হলো তাঁর সম্পর্কে আমাদের সমাজে বিদ্যমান দুটো ধারণা। এই ভাসানী ‘লাল’ ভাসানী’ নন। ইনি ‘সবুজ ভাসানী’। পীর। রুহানিয়াতের রাহবার।
ভাসানী কিন্তু দুটোই একসঙ্গে। একদিকে তিনি যেমন, মার্কস ও লেনিনীয় অর্থে রেভ্যুলেশনারি ঠিক তেমনি তিনি অনাথ নিরাশ্রয় দিশাহারা মানুষের পীর, তাদের পথ প্রদর্শক। দ্বিতীয় ভাসানীকে শিক্ষিত শ্রেণী খুব কমই চেনে। রেভ্যুলেশন অর্থে তাঁর বিপ্লবী দিকটা যেমন আছে, তেমনি তাঁর অন্য ‘সবুজ’ দিকটাও গুরুত্বপূর্ণ।
রাজনৈতিক কৌশল– বিশেষত রাষ্ট্রক্ষমতা চ্যালেঞ্জ করবার কলাকৌশল আবিষ্কারের ক্ষেত্রে উপমহাদেশে তাঁর জুড়ি ছিল না। শুধুমাত্র গণঅভ্যুত্থানের ক্ষেত্রে তিনি নতুন ধরনের বিভিন্ন নজির স্থাপন করেছেন উপমহাদেশে, তা না কিন্তু। একটি কৃষি প্রধান সংস্কৃতির মধ্যে শ্রুতি ও কণ্ঠ নির্ভর জনগোষ্ঠীকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন করে তোলার কৌশল তিনি নানাভাবে প্রদর্শন করেছেন। তিনি না থাকলে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান অসম্ভব ছিল। এই যেমন ঘেরাও আন্দোলন, এটা কিন্তু ভাসানীর আবিষ্কার। অথবা পুলিশ এসে যখন কোনো মিছিল করতে দিচ্ছে না, তখন হঠাৎ করে ভাসানী আল্লাহু আকবার বলে নামাজ পড়তে দাঁড়িয়ে গেলেন। আন্দোলনের এমন নানাবিবিধ দুর্দান্ত কৌশল তিনি আবিষ্কার করেছেন। এমন উদাহরণ দিতে গেলে মেলা গল্প চলে আসে।
আরও বিখ্যাত গল্পটা হলো এই, তিনি যখন কোনো সম্মেলন করতেন, সেই সম্মেলনে কৃষকরাই কিন্তু চাল, ডাল, ছাগল, গরু নিয়ে আসতেন। তাঁর সম্মেলনে কৃষক কিন্তু সরাসরি অংশগ্রহণ করতেন। ফলে ভাসানীর গণঅভ্যুত্থানটা ছিল মূলত এমন একটা চর্চা, যাকে আমরা রাজনৈতিক সাহিত্যে গণসার্বভৌমত্ব বিকাশের চর্চা– অর্থাৎ জনগণের সামষ্টিক অভিপ্রায়কে ‘বর্তমান; বা বাস্তব করে তোলার রাজনৈতিক কৌশল বলতে পারি। যে রাজনৈতিক পরিসরটা তিনি গড়ে তুলতে চাইতেন– সেখানে জনগণ অংশগ্রহণ করত সরাসরি, পরোক্ষভাবে নয়। এমনকি তাদের খাদ্য সংস্থান, থাকার ব্যবস্থা পুরোটাই কিন্তু ওই কৃষক নিজেরাই করতেন। শুধু ভাসানীর সাংগঠনিক পদ্ধতি নিয়েও যদি আমরা আলোচনা করি, সেটা নিয়ে দীর্ঘ কথা বলা যাবে, কত যে অভিনব ছিলেন তিনি।
গণঅভ্যুত্থান সংগঠিত করাটা ভাসানীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। আর পাশাপাশি আরেকটা বিষয় হলো গণঅভ্যুত্থানের সাংগঠনিক কাজ করতে গিয়ে একই সঙ্গে বাংলাদেশে একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তুলবার ভিত্তিটা তিনি স্থাপন করে দিয়েছেন। ভাসানী যদি না থাকতেন, শেখ মুজিবুর বলে কেউ থাকতেন না। এটা খুব পরিষ্কার করে আমাদের বুঝতে হবে। এই যে দীর্ঘ ফ্যাসিস্ট শাসনের ফলে আমরা ভাসানীকে মুছে ফেলেছি, কিন্তু তাঁকে ভুলে যাওয়া অসম্ভব।