ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ১০০ দিন পেরোতে না পেরোতে এই অভ্যুত্থানের অন্যতম প্রাণশক্তি ‘অন্তর্ভুক্তিমূলকতা’ শব্দটি খানিকটা যেন সাইডলাইনের শব্দ হয়ে উঠেছে। বলা যায় এই শব্দটির মানে অনেকের কাছে তাদের নিজেদের মতে অন্তর্ভুক্ত হওয়া হয়ে উঠেছে। অথচ শেখ হাসিনার দীর্ঘ স্বৈরাচারী শাসন ও অপমান, তার অলিগার্ক ও আমলাদের সম্পদ লুণ্ঠন, দুর্নীতি ও পাচারের বিরুদ্ধে ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণির মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন। জীবন দিতে হতে পারে সেটি অনিবার্য জেনেও তাঁরা হাসিনার পুলিশ, র্যাব ও নিরাপত্তা বাহিনী ও ভাড়াটে অস্ত্রধারীদের বুলেটের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। অভ্যুত্থানের জনপ্রিয় স্লোগান হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাই, ‘তুমি কে, আমি কে, বিকল্প বিকল্প’।
অভ্যুত্থানের দিনগুলোতে এবং পরের দিনগুলোতে শিক্ষার্থীরা নতুন বাংলাদেশ কেমন হবে দেয়ালে দেয়ালে তার যে ছবি এঁকেছে, সেখানে একটি প্রধান সুরই ছিল অন্তুর্ভুক্তিমূলকতা। শুধু ঢাকায় নয়, সারা দেশের শিক্ষার্থী গ্রাফিতিতে নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নের কথা জানিয়েছেন। সম্প্রতি আমি যশোরে গিয়েছিলাম। এম এম কলেজের দেয়ালে দেখে এসেছি, ‘কল্পনা চাকমা কোথায় গেল জবাব দাও’ লেখা গ্রাফিতি। ‘পাতা ছেঁড়া নিষেধ’ শিরোনামে একটি গাছের পাঁচটি পাতায় আদিবাসী, খ্রিষ্টান, হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলিম লেখা অন্তুর্ভুক্তিমূলকতার আইকনিক সেই গ্রাফিতিটিও সেখানে ঠাঁই পেয়েছে।
একটি বিপ্লব, একটি অভ্যুত্থান সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গাটিই হলো মানুষে মানুষে সংহতিবোধ। কার কী দল, কার কী মত, কার কী পরিচয় সেটিকে পেছনে রেখে মানুষ পথে নামে, পথেই তৈরি হয় অভূতপূর্ব সংহতি। অভ্যুত্থান তাই সমাজের ভেতরে প্রচণ্ড এক শক্তির জন্ম দেয়। সেই শক্তি সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তনের বিপুল এক সম্ভাবনা তৈরি করে; কিন্তু সেটি ব্যবহার করা না গেলে সেই শক্তিই সমাজে নানা সংঘাত ও হানাহানির জন্ম দিতে পারে।
আমাদের ইতিহাসেই এর সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত ১৯৭১। ষাটের ছাত্র আন্দোলন, জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও গণ–অভ্যুত্থানের পথ ধরে যে মুক্তিযুদ্ধ, সেখানে পাকিস্তানি গণহত্যার বিরুদ্ধে এই ভূমির আপামর মানুষ জান বাজি রেখে লড়াইয়ে নেমেছিলেন। সেই যুদ্ধ হয়ে উঠেছিল সত্যিকারের এক গণযুদ্ধ। মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম, চীনপন্থী কমিউনিস্ট পার্টির একটি অংশ ছাড়া রাজনৈতিকভাবে মুক্তিযুদ্ধ ছিল সবার যুদ্ধ।
অথচ যুদ্ধের মালিকানা দাবি করে বসল আওয়ামী লীগ একা। মুক্তিযোদ্ধাদের দেশ গঠনের কাজে যুক্ত না করে ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। মুজিব বাহিনী ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমতায়িত করে দেশকে বিভক্ত করা হলো। মুক্তিযুদ্ধে সেই বিপুল সম্ভাবনাময় শক্তিকে দেশগঠনের কাজে, সমাজ পরিবর্তনের কাজে ব্যবহার করতে না পারার ব্যর্থতায় অন্তত দুই দশকব্যাপী সামরিক ও রাজনৈতিক হানাহানি ও বিপুল রক্তক্ষয়ের জন্ম দিয়েছিল।
জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানও আমাদের সমাজে বিশেষ করে তরুণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিপুল সম্ভাবনার শক্তি তৈরি হয়েছে। আওয়ামী লীগ ও দলটির মিত্রদের সুবিধাভোগী অংশ ছাড়া এই অভ্যুত্থানে কে অংশ নেয়নি। এমনকি যাঁদের মা–বাবা আওয়ামী লীগের সমর্থক, তাঁদের সন্তানেরাও রাস্তায় নেমে স্বৈরাচারী শাসনের বিরোধিতা করেছেন। সবাই আশা করেছেন, এমন এক বাংলাদেশ যেন তৈরি হয়, যেটি হবে গণতান্ত্রিক, মানবিক ও বহুত্ববাদী।
অভ্যুত্থানের ১০০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার পর যে প্রশ্নটি উঠতে শুরু করেছে—অভ্যুত্থানে যে বিশাল শক্তির জন্ম হলো, সেটিকে কি সমাজের ইতিবাচক বিকাশের কাজে ব্যবহার করা যাচ্ছে? শুরুটা করা যাক, গত মাসে ঢাকার কলেজগুলোর শিক্ষার্থীদের মধ্যকার সংঘাতের দৃষ্টান্ত দিয়ে। ঢাকা কলেজ ও সিটি কলেজের কয়েকজন শিক্ষার্থীর মধ্যে বাসে ওঠা নিয়ে কথা–কাটাকাটির জেরে মারামারি শুরু হলো। এরপর দুই কলেজের বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী রাস্তায় নেমে পরস্পরের দিকে ইটপাটকেল ছুড়তে লাগল। লাঠিসোঁটা নিয়ে মারামারি করতে শুরু করল। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে গিয়ে যৌথ বাহিনীকে বাড়াবাড়ি রকমের পিটুনি দিতেও দেখেছি আমরা ফেসবুকের ভিডিওতে।