বাংলাদেশের খুব কাছেই পশ্চিমবাংলা, আমাদের নিকট প্রতিবেশী।ওখানকার পাখিরা উড়ে এসে বাংলাদেশের গাছগুলোতে বসে গান করে। বাংলাদেশের হাওয়া ওখানে গিয়ে গাছে গাছে দোল দেয়।ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে পশ্চিমবাংলার সঙ্গে আমাদের অনেক মিল।আমাদের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কে টানাপোড়েন হলে, কলকাতার হোটেলগুলো ৬০ ভাগ ফাঁকা থাকে, তাদের নেতাদের চিন্তাও বেড়ে যায়।পচিমবাংলার ঘটনাবলিও, বিশেষ করে বাংলাদেশকে নিয়ে কাণ্ডকারখানা, আমাদেরকেও খুব আলোড়িত করে।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী পাঠাতে উদ্যোগী হওয়ার জন্য।বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের নিয়ে রাজনীতি করা ভারতীয় রাজনীতিবিদদের পুরোনো অভ্যাস। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে মনে করা হতো তিনি সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ঊর্ধ্বে থাকার চেষ্টা করেন, ঊর্ধ্বে থাকেন।কিন্তু রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই।
বাংলাদেশে এমন কিছু হয়নি যে শান্তিরক্ষী লাগবে! এটা ঠিক, পশ্চিমবাংলার রাজনীতির কিছু সংকট মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বেশ কোনঠাসা করেছে বেশ কিছুদিন ধরে। ফলে বাংলাদেশে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী পাঠানোর মতো অপ্রত্যাশীয় এই মন্তব্য তার নিজের সংকট থেকে সেখানকার জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরাবার একটা চেষ্টা বলে ভাবা হচ্ছে। মমতা যে কারণেই এই সব কথা বলুন না কেন, বাংলাদেশের জন্য এটা নতুন ভাবনার জন্ম দিয়েছে।বাংলাদেশ সরকারকে কূটনীতির প্রধান অস্ত্র দ্বিপক্ষীয় আলাপ-আলোচনাতে ফিরে যেতে হবে।পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে এবং বড় বড় প্রতিবাদ মিছিল বের করে এইসব সমস্যার কোনো সমাধান হবে না, বরং সমস্যা আরো বাড়বে। কেউ কারো পতাকার অবমাননা করে কোনো ফল হবে না, সমস্যা বাড়বে এবং দুই পক্ষেরই অসম্মান হবে। ব্যক্তিগত কূটনীতিতে ফিরে যেতে হবে। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক জরাজীর্ণ করে আমাদের কোনো লাভ হবে না। দুর্ভাগ্যক্রমে দুদেশেরই কিছু লোক রাজনীতির উদ্দেশে এই সংকটটাকে জিইয়ে রাখতে চান। মমতা বন্দ্যোধ্যায়কে সেই দলে ভাবতে খুব কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু তিনি যখন বাংলাদেশের সংকট নিয়ে কথাবলছেন, তখন তার নিজের সংকটগুলোও কম নয়।পশ্চিমবাংলার গত চার মাসে কত কিছু ঘটে যাচ্ছে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শাসন ক্ষমতাও টলোমলো হয়ে উঠেছিল দারুণভাবে, অনেকটা শেখ হাসিনার মতো।
২০২৪ সালের ৯ অগাস্ট। হাসপাতালের রোগীদেরকে নিয়ে সারা দিন ও রাত্রি কাজ করে, ৩১ বছর বয়স্ক একজন নারী ইন্টার্নি ডাক্তার একটু বিশ্রামের জায়গা খুঁজে পেলেন একটা সেমিনার রুমের কোনে, গা এলিয়ে বিশ্রাম নিতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন নিজের অজান্তে। এটাই সম্ভবত তার শেষ নিদ্রা– এরপর তাকে ঘুমিয়ে পড়তে হলো মৃত্যুশয্যায়, চিরদিনের জন্য শেষ নিদ্রায়।আর জি কর মেডিকেল কলেজের সহকর্মীরা সকালে খুঁজে পেলেন মেয়েটির অর্ধনগ্ন মৃতদেহ।তার সমস্ত শরীরে ছিল আঘাতের চিহ্ন। আর জি কর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল ১৩৮ বছরের পুরানো প্রতিষ্ঠান। এখানে ইন্টার্নি ডাক্তারররা কাজ করেন একনাগাড়ে ৩৬ ঘণ্টা, কিন্তু তাদের বিশ্রামের নির্দিষ্ট কোনো স্থান নেই।তাই তাদেরকে সাধারণত গিয়ে বিশ্রাম নিতে হয় তিনতলার সেমিনার রুমে।
আর জি কর মেডিকেলের এই হিংস্রতা প্রথম থেকেই সবাই বুঝেছিল এটা যৌন নির্যাতনের পর হত্যাকাণ্ড। পরে বিভিন্ন ডাক্তারি পরীক্ষায় তা-ই প্রমাণিত হয়।কিন্তু প্রাথমিক অবস্থায় পচিমবাংলার স্বাস্থ্য ও পুলিশ বিভাগ তদন্তে গড়িমসি করে, অনেকের অভিমত তারা এটাকে একটা আত্মহত্যা বলে নিজেদের দায়িত্ব এড়াতে চেয়েছিল এবং চেয়েছিল নিজেদেরকে ঝামেলামুক্ত রাখতে। যাকে সম্ভাব্য খুনি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, সে ছিল স্বাস্থ্য বিভাগের একজন অনিয়মিত কর্মী, কিন্তু হাসপাতালগুলোতে তার ছিল অনিয়ন্ত্রিত প্রবেশধিকার।
এই ঘটনায় প্রথমে আর জি করের ডাক্তারেরা প্রতিবাদ ও ধর্মঘট শুরু করে। পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সারা পশ্চিমবাংলা ও ভারতের অন্যান্য রাজ্যের ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীরা প্রতিবাদে ফুঁসে উঠলো। পুরো পচিমবাংলার ডাক্তারের শুরু করলেন ধর্মঘট, বন্ধ করলেন রোগী দেখা। এমনকি বন্ধ হলো জরুরি বিভাগগুলোও, রোগীদের দুর্ভোগ বাড়ল।
পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আবার সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রীও।তিনি ভাবলেন, একটা বিবৃতি দিয়ে তাকে সামাল দিতে পারবেন এবং ডাক্তাররা দুয়েক দিন বিক্ষোভ দেখিয়ে আবার কাজে ফিরে আসবে। আরো ধারণা ছিল তার বিশ্বস্ত পুলিশ প্রধান বিনীত গোয়াল এই সমস্যা সহজেই সামাল দিতে পারবেন।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এমনিতেই দারুণ আত্মবিশ্বাসী রাজনীতিবিদ, তিনি ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবাংলায় মোদীর দলকে হারিয়ে অনেক বেশি আসন ছিনিয়ে নিয়েছেন। আর একগুঁয়েমির জন্যও তিনি খ্যাত।তার দলের নাম তৃণমূল কংগ্রেস– তাকে বলা হয় একাই তিনি তৃণমূল আর তৃণমূল অর্থই মমতা ব্যানার্জী। ডাক্তাররা চাইলেন কলকাতার পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়াল, তার ডেপুটি অভিষেক গুপ্ত ও আর জি করের প্রিন্সিপাল সন্দীপ ঘোষের তাৎক্ষণিক প্রত্যাহার। তারা মমতার স্বাস্থ্য বিভাগের কয়কয়জন উচ্চপদের অফিসারেরও শাস্তি দাবি করলেন, যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে হত্যা ও যৌন নির্যাতনের সাক্ষ্য প্রমাণাদিকে পরিবর্তন করার। ডাক্তাররা আরো চাইলেন সরকারকে অবিলম্বে সব হাসপাতালের স্বাস্থ্য কর্মীদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে।