‘অজস্র কৌটিল্যে বিচ্ছুরিত’ বাক্যকে বিষয়ানুগ করতে এ লেখার এ শিরোনাম। কী অসাধারণ কাব্যিক সুষমা অলোক রঞ্জন দাশগুপ্ত উপহার দিয়েছেন। কিন্তু যে সময়-সমাজ নিয়ে বলা, তা নিশ্চিত কোনো ভাবনার আরাম দেয় না। কৌটিল্য শব্দের সুলুক-সন্ধানে পাওয়া যায়, এর মানে স্বভাব বা মনের ক্রূরতা, কুটিলতা।
প্রথম মৌর্য সম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের মন্ত্রণাদাতা ও ‘অর্থশাস্ত্র’ গ্রন্থের প্রণেতা, চাণক্য। আমাদের বিচার বিভাগের ওপর নানা সময়ে নানা ধরনের কৌটিল্য প্রভাব বিস্তার করে এর স্বাধীনতা স্বাতন্ত্র্য বাধাগ্রস্ত করতে চায়। সরকারের ধরন নির্বিশেষে (অ)নির্বাচিত/(অ)গণতান্ত্রিক কুটিলতা জারি থাকে। এখন বিশেষ ধরনের সরকার, কিন্তু চাণক্য চাল থামেনি।
আইন প্রণয়নের এক ঐতিহাসিক সীমাবদ্ধতার আলাপ করেছিলেন কেসভিক। তিনি বলেন, ‘বিচারের পর্বতপ্রমাণ ভ্রান্তি হচ্ছে কোনো কোনো গোষ্ঠী এই বিশ্বাস দ্বারা আক্রান্ত যে ন্যায়পরতাকেও আইনের অক্ষর দ্বারা বিধিমালায় রূপান্তর ঘটানো যায়। তারা ভুলে যায় কিংবা জানেনই না যে প্রাচীন গ্রিকরা ব্যর্থ হয়েছেন, হয়েছেন রোমানরা, এমনকি শিল্পবিপ্লবের উন্নত দশাও এই ভ্রান্ত অসম্ভাব্যতাকে জারি রেখেছে। চারিত্রিক ন্যায়পরতার ব্যাপারে আইনের খসড়া যার দায়িত্ব, তার চাইতে বড় নির্বোধ আর বোধ হয় কেউ নাই।’
আমরাও নিষ্পাপ আশা নিয়ে অপেক্ষায় আছি ‘বিচার বিভাগের স্বাধীনতা’, ‘সংস্কার’—এই সব পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যথানিয়মে ঘটবে। ভুল, বড্ড ভুল; না হলে বিচার বিভাগের পৃথক্করণ নিয়ে এখনো নেতিবাচক প্রচারণা চলে! কারণ, কায়েমি কৌটিল্য তো ছেড়ে যায়নি আমাদের।
গত ১ নভেম্বর দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় ‘ফিরে দেখা বিচার বিভাগ পৃথক্করণ’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। প্রবন্ধটিতে মাসদার হোসেন মামলার (হাইকোর্ট বিভাগের মামলা নম্বর ২৪২৪/৯৫ এবং আপিল বিভাগের মামলা নম্বর ৭৯/৯৯) পর্যালোচনা করা হয়েছিল। প্রবন্ধটিতে বিচার বিভাগ পৃথক্করণের দিবসে বিগত ১৭ বছরে জনগণের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির একটি চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু কিছু বিষয় অনাকাঙ্ক্ষিত বিবেচনায় আদালতের নজরে আনলে অবমাননার রুল ইস্যু হয়। পরে অবশ্য লেখক অনুতাপ প্রকাশ করেছেন।
সংবিধান ব্যাখ্যায় যুক্তরাষ্ট্রের চাইতে উদারতার উদাহরণ অল্প দেশই স্থাপন করতে পেরেছে। কারণ, সেখানে সংবিধানের ব্যাখ্যায় কোনো একমুখী পথ বেছে না নিয়ে বহুমাত্রিকতা চর্চায় পরিণত করেছে। নানা সময়ে একই সাংবিধানিক অনুচ্ছেদের বিভিন্নমুখী, যদি তা পরস্পরবিরোধীও হয়, তা–ও তারা অনুমোদন করেছে। তবে স্বতঃসিদ্ধ এই নীতি মেনেছে যে সুপ্রিম কোর্ট আইন তৈরি করে না, বরং আইনের ব্যাখ্যা করে এবং একই সঙ্গে সেখানে ‘লেজিসলেটিভ ভারডিক্ট’-এর চর্চা আছে।
সংবিধান তাত্ত্বিক অধ্যাপক রুবেনফেল্ডের রেভল্যুশন বাই জুডিশিয়ারি: দ্য স্ট্রাকচার অব আমেরিকান কনস্টিটিউশনাল ল বইতে তিনি সাংবিধানিক টেক্সট, কাঠামো ও ইতিহাসকে আমলে না নিয়ে আধুনিক অনুশীলনকেই যথার্থতা দিয়েছেন। (ইয়েল ল জার্নাল, হাউ টু ইন্টারপ্রেট দ্য কনস্টিটিউশন অ্যান্ড হাউ নট টু, ২০০৫)। অনেক সাংবিধানিক আইন তাত্ত্বিকই এই মত দিয়েছেন যে যুক্তরাষ্ট্রের নবম সংশোধনী সংবিধানের টেক্সটকে সুবিধা অনুযায়ী ব্যাখ্যার পক্ষে বিচারকদের রায় দানকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করা উচিত।
যুগান্তরের লেখাটিতে একটি বিষয় আছে যেখানে দাবি করা হয়েছে, মাসদার হোসেন মামলায় যা চাওয়া হয়নি তা–ও দিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে আমেরিকার সাংবিধানিক আইন চর্চার এই রীতি সু–উপযুক্ত উত্তর হতে পারে। ‘ডিউ ডিলিজেন্স’ আইন চর্চায় খুব প্রচলিত শব্দ এবং বিচার বিভাগ নিয়ে আলোচনা সেটি যেকোনো প্ল্যাটফর্মেই হোক, তাতে যথাযথ সতর্কতা ও সংবেদনশীলতা কাম্য। অনভিপ্রেত কোনো মন্তব্য প্রত্যাশিত নয়।
কোনো পেশাজীবী সংগঠনের নির্বাচন আলোচনার দাবি করে যখন ২৫ বছর পর তা প্রভাবমুক্ত অবস্থায় হয়। জাতীয় নির্বাচনের মতো এটিও একটি চক্রের শিকার ছিল। দীর্ঘ ২৫ বছর পর বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের গণতান্ত্রিক নির্বাচন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। খুলনা জেলার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. আমিরুল ইসলাম বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী কমিটির সভাপতি এবং কুষ্টিয়া জেলার যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ মুহাম্মদ মাজহারুল ইসলাম মহাসচিব নির্বাচিত হয়েছেন। প্রথম আলো সূত্রে জানা যায়, অনলাইনে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। মোট ভোটার ছিলেন ৬৪ জেলার ২১৮৫ বিচারক। ভোট দিয়েছেন ২ হাজার ৩৫ জন। এটা কৌটিল্যমুক্ত করা গেছে।