২৩ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনীর একটি ব্যাটালিয়ন মিডিয়াম কামানের সহায়তা নিয়ে কাগজপুকুরের ওপর আক্রমণ চালায়। আমাদের রক্ষণব্যূহের সামনে ইপিআরের দুই কোম্পানি, পেছনে ১ম ইস্ট বেঙ্গলের দুই কোম্পানি। ইপিআর সৈনিকেরা মুহুর্মুহু কামানের গোলার আঘাতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে এবং পিছিয়ে আসতে বাধ্য হয়। হাবিলদার মুজিবুর রহমান বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করে শত্রুর ব্যাপক ক্ষতি করে শহীদ হন। তাঁকে মরণোত্তর বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়।
কাগজপুকুরে দীর্ঘ সময় পাকিস্তানি বাহিনীকে ঠেকানো সম্ভব ছিল না। আমার প্ল্যান ছিল শত্রুর ক্ষয়ক্ষতি সাধন করে পিছিয়ে এসে আবার রক্ষণব্যূহ গড়া। ১ম ইস্ট বেঙ্গলের দুই কোম্পানি বেনাপোল চেকপোস্টের এক কিলোমিটার পূর্বে নতুনভাবে ডিফেন্স নেয়। সৈনিকদের নির্দেশ দিলাম, মাতৃভূমির এই ক্ষুদ্র অংশটুকু জীবনের বিনিময়েও রক্ষা করতে হবে। বেনাপোল চেকপোস্টে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা পতপত করে উড়ছে, পৃথিবীর বহু দেশে টেলিভিশনের মাধ্যমে এ দৃশ্য সবাই দেখছে। পাকিস্তান সরকার স্থানীয় কমান্ডারকে আদেশ দিয়েছে এ পতাকা নামিয়ে পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলনের জন্য।
গ্র্যান্ড ট্রাংক রোড মাঝখানে রেখে আমাদের দুটি কোম্পানি বাংকার খুঁড়ে শক্ত প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। প্রতিদিন পাকিস্তানি বাহিনী কামানের সাহায্য নিয়ে আমাদের ওপর আক্রমণ করে, আমরা প্রতিটি আক্রমণ সফলভাবে প্রতিরোধ করি। লে. মেঘ সিংকে অনুরোধ করে ৬টি ৩ ইঞ্চি মর্টার সংগ্রহ করি তাঁর কাছ থেকে। আমাদের শক্তি বৃদ্ধি হয়।
এলাকার ভৌগোলিক অবস্থান এমনই যে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যোদ্ধাদের পক্ষে এলাকা রক্ষা করা খুব কঠিন নয়। আমরা মরণপণ লড়াই করে যাচ্ছি। প্রতিদিন শেলের আঘাতে আমাদের পক্ষে হতাহত হচ্ছে কিন্তু শত্রুর ক্ষয়ক্ষতি আমাদের তুলনায় অনেক বেশি। মহাসড়কের ওপর রয়েছে শতবর্ষী বিশাল বৃক্ষরাজি, যা আমাদের কামানের গোলা থেকে কিছুটা প্রটেকশন দেয়।
ইতিমধ্যে মুক্তিযুদ্ধে বাঙালিদের বীরোচিত সংগ্রামের কথা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্বব্যাপী জনমত সংগঠিত হয় স্বাধীনতার সপক্ষে। পাকিস্তান দূতাবাসে কর্মরত বাঙালি কূটনীতিকদের কয়েকজন লন্ডন, ওয়াশিংটন, কলকাতা, দিল্লি, বাগদাদ প্রভৃতি স্থানে বিদ্রোহ করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন। অন্যদিকে পাকিস্তানি বাহিনী বাংলাদেশে তাদের অত্যাচার-নির্যাতন ব্যাপকভাবে চালিয়ে যাচ্ছে।
ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে নিরীহ মানুষ হত্যা, ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, নারী নির্যাতন করে পাকিস্তানি সেনারা এক নারকীয় তাণ্ডব সৃষ্টি করে। প্রায় এক কোটি নির্যাতিত মানুষ প্রাণভয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে প্রবেশ করেন। সে দেশের সরকার তাঁদের আশ্রয়, খাদ্য ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করে। শরণার্থীদের সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকে।
হাজার হাজার ছাত্র-যুবকের দল মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে প্রবেশ করে। তাদের দেওয়ার মতো অস্ত্র আমাদের নেই। ভারত সরকার সমরাস্ত্র সরবরাহের ব্যাপারে তখনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেনি। সীমান্তে ছাত্র-যুবকদের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে বহু ইয়ুথ ক্যাম্প। অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন গ্রামীণ যুবকেরা। অস্ত্র ও ট্রেনিং পেলেই তাঁরা গণহত্যার প্রতিশোধ নিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
...মুক্তিবাহিনীতে অফিসারের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় কম। ফলে অপারেশন পরিচালনা আশানুরূপ হচ্ছিল না। শিক্ষিত ও সাহসী মুক্তিযোদ্ধাদের সামরিক প্রশিক্ষণের পর কমিশন প্রদান করে এ ঘাটতি পূরণের সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ সরকার। ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর ক্র্যাকডাউনের পর ছাত্র-যুবকদের কয়েকজন ঘরবাড়ি ছেড়ে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার উদ্দেশ্যে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে প্রবেশ করে।
এদের মধ্যে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের মেধাবী ছাত্ররাও ছিল। এরা অত্যন্ত সাহসী, দেশপ্রেমিক, পাকিস্তানি বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এরাই ছিল প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা, যাদের কাছে স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গ করা নিতান্তই সহজ-সরল একটা কর্তব্য। ছাত্র-যুবকদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ যখন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করছিল, সে সময় এসব দামাল ছেলে পরিবার-পরিজনের আশ্রয় ছেড়ে অনিশ্চয়তার বিপৎসংকুল পথে স্বপ্রণোদিত হয়ে পাড়ি জমিয়েছে।
ভারতের উত্তরাঞ্চলে ভুটান সীমান্তের কাছাকাছি মূর্তিতে মুক্তিযোদ্ধা যুবকদের জন্য ট্রেনিং ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। ভারতীয় সেনা অফিসাররা সেখানে প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। তিন মাস প্রশিক্ষণের পর ৬৪ জন যুবককে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কমিশন দেওয়া হয়। পাসিং আউট প্যারেডে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম সালাম গ্রহণ করেন। ক্যাডেট সাইদ আহমদ* সেরা ক্যাডেট বিবেচিত হয় এবং সি-ইন-সির কেইন অর্জন করে।