ছোটবেলা থেকেই আমরা রাজকুমারীদের গল্প শুনে ও দেখে বড় হয়েছি। সিনড্রেলা বা স্নো হোয়াইটের সেই মনোরম গল্পগুলোর সঙ্গে কল্পনার কত ডালপালা মেলে দিতাম! কখনো তাদের মতো জীবন চাইতাম। আবার কখনো তারা যেন এই চিরদুঃখের জীবন থেকে বের হতে পারে বা এমন জীবন যেন আর কারও না হয় সে কামনাও করতাম। আর সেই ছোটবেলাতেই গল্পে-গল্পে আমাদের অবচেতনে চলে আসে লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যের ধারণাগুলো। যেখানে মেয়েদের দুর্বল ও পিছিয়ে পড়া হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।
শত শত বছর ধরে সামাজিকভাবে নির্মাণ করা এসব বদ্ধমূল ধারণা কতটা নেতিবাচক হতে পারে, তা এখন কিছুটা ধারণা করতে পারি। এ রকম অসম ও অন্যায্য বয়ান নির্মাণের মাধ্যমে আসলে নারীদের সমাজের বৃহত্তর অংশ থেকে আলাদা করে রাখা হয়।
১৯২২ সালে ‘পাবলিক ওপিনিয়ন’ বইয়ে প্রথম এই জেন্ডার স্টেরিওটাইপিংকে সমাজবিজ্ঞানের শাখা হিসেবে চিহ্নিত করেন ওয়াল্টার লিপম্যান। স্টেরিওটাইপকে তিনি এখানে সামাজিক গোষ্ঠীগুলোর জ্ঞান, বিশ্বাস ও চাহিদা হিসেবে দেখান।
বৈষম্যমূলক সমস্যা হিসেবে জেন্ডার স্টেরিওটাইপিং এখনও আমাদের সমাজে বিদ্যমান। ২০২১ সালে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল ইউকে পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা যায়, ১১-১৮ বছর বয়সী ৬৮ শতাংশ কিশোরী মনে করে, জেন্ডার স্টেরিওটাইপিংয়ের কারণে নারী ও কিশোরীরা পিছিয়ে পড়ছেন। এদের মধ্যে ৫২ শতাংশ কিশোরী মনে করেন, তারা পুরুষ বা ছেলেদের মতো সবকিছু করতে পারার সমান অধিকার থেকে বঞ্চিত।
আমাদের সমাজে কিশোরীদের সক্ষমতাগুলো যেন কখনই সম্ভাবনাময় হয়ে উঠতে না পারে, তার ব্যবস্থা করা হয়। এখন সময় এসেছে, পুরোনো এই ধারণাগুলোকে আমাদের প্রশ্নের মুখোমুখি করতে হবে; যাচাই-বাছাই করে দেখতে হবে।
আমাদের সমাজ বহু প্রজন্ম ধরে নারী ও পুরুষের বিভেদের বীজ বপন করে রেখেছে। এমনকি এই বিভেদের শিকড় আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অনেক গভীর পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। এখানে পুরুষদের বলশালী, দায়িত্বশীল ও প্রতিযোগিতামূলক হিসেবে দেখানো হয়। আর নারীদের দেখানো হয় নম্র, শান্ত, স্নেহশীল ও গভীরভাবে আবেগপ্রবণ হিসেবে। আর পারিবারিক, সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় কাজ বা দায়িত্বও সেভাবেই বণ্টন করার প্রবণতা তৈরি হয়। অথচ এই বিভেদের মাধ্যমে নারী-পুরুষ উভয়েরই সম্ভাবনার পথ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। বিশেষ করে এই পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠীই নারী; তাদের জন্য সমতা নিশ্চিত না করে কীভাবে বৈষম্যহীন বিশ্ব নির্মাণ সম্ভব, তা আমাদের ভেবে দেখতে হবে।
সমাজে নারী-পুরুষ নির্বিশেষ সবার জন্য সমতাভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণ করতে চাইলে সর্বপ্রথম আমাদের সহানুভূতি তৈরিতে কাজ করতে হবে। সহানুভূতি ও সহমর্মিতার মতো বিষয়গুলো আসলে পরিবারের চর্চা করার মতো বিষয়। আমরা সবাই জানি যে একজন শিশু তার মা-বাবা, আত্মীয়স্বজন, আশপাশের প্রতিবেশ থেকে শেখা শুরু করে। সেখানে বাকিরা আরেকজনের প্রতি কেমন মনোভাব দেখাচ্ছে, তার অপর শিশুদের পরবর্তী জীবনের আচরণ নির্ভর করবে।
আজকাল এই ধরনের সামাজিক সচেতনতা নির্মাণে মিডিয়াগুলো ইতিবাচক ভূমিকা পালন করছে। কোনো এক বিজ্ঞাপনে দেখেছিলাম, এক কিশোর অন্য আরেক কিশোরীর সঙ্গে হয়রানিমূলক আচরণকে খুব আনন্দদায়ক বলে মনে করছে। কিন্তু ঘটনাটা ওই কিশোরের মায়ের সামনে ঘটে যায়। বিজ্ঞাপনের ওই মা তার ছেলেকে শুধু বলেছিলেন, আমার সঙ্গেও ছোটবেলায় এমন হয়রানির ঘটনা ঘটতো। তখন মায়ের কেমন লাগত সেই অনুভূতি বোঝার পর, ওই কিশোরের পক্ষে আর কখনই কাউকে হয়রানি করা সম্ভব হবে না। মায়েদের উচিত তাদের গল্প ও অনুভূতিগুলো তাদের ছেলেদের সঙ্গে শেয়ার করা, যেন তারাও নারীদের কষ্ট বুঝতে পারে। যেন ছেলেরাও অন্য নারীদের সঙ্গে সহানুভূতিশীল ব্যবহার করতে পারে।