একটা সময় দেশে ছিল একটাই চ্যানেল—বিটিভি। সেখানে যা প্রচারিত হতো তার সবই থাকত দর্শকের মুখস্থ। বাংলাদেশের টেলিভিশনের দর্শকসংখ্যা দিন দিন কমছে। এখন অনেক চ্যানেল, কিন্তু আগের মতো দর্শক নেই কোনো চ্যানেলেই।
ক্রমেই দর্শক বিদেশি চ্যানেলমুখী হচ্ছে। আগে এই প্রবণতা শহরাঞ্চলের দর্শকদের মধ্যে পরিলক্ষিত হলেও এখন গ্রামীণ এলাকার টিভি দর্শকরাও ব্যাপক হারে বিদেশি চ্যানেলের অনুষ্ঠান দেখার প্রতি ঝুঁকছে। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে ইন্টারনেটের প্রসার এবং ওটিটি প্ল্যাটফরমের আধিপত্য। টেলিভিশনে কোথায় কী প্রচারিত হচ্ছে, তার খোঁজ রাখে না কেউ।
কেন এমন হলো? দর্শক ফেরানোর উপায় কী? আজ বিশ্ব টেলিভিশন দিবসে কথা বলেছেন তিন গুণীজন। শুনেছেন হৃদয় সাহা।
ডকু ড্রামা ও নন-ফিকশনে নজর দেওয়া উচিত
মামুনুর রশীদ, নাট্যব্যক্তিত্ব
টেলিভিশনের দর্শক হারিয়ে গেছে বলার চেয়ে টেলিভিশন তার দর্শক ধরে রাখতে পারেনি, এটা বলা বেশি যুক্তিযুক্ত। মানুষ এখনো টেলিভিশন দেখতে চায়, দুই-তিন মাস ধরে খবর খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, মানুষ দেখছে। যেহেতু বেশ কয়েক বছর ধরে রাজনৈতিকভাবে একই ধারা চলছিল, তাই মানুষ খবর দেখায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিল। এখন যদি চ্যানেলগুলো সংবাদ প্রচারে গ্রহণযোগ্যতা ধরে রাখতে পারে তাহলে মানুষ খবর দেখবে।
শুধু তরুণ প্রজন্ম নয়, এখন বয়োবৃদ্ধ মানুষের কাছেও স্মার্ট ফোন আছে, খবর তারা সেখানেও দেখতে পারে। মানুষ দিন দিন আরো বেশি কর্মব্যস্ত হয়ে পড়ছে, সময় নির্ঘণ্ট বেঁধে টিভির সামনে বসে অনুষ্ঠান দেখা অনেকের পক্ষেই সম্ভব না। ইউটিউব আছে, যখন সুযোগ পাচ্ছে তারা তখন দেখে নিচ্ছে।
বিনোদনের জন্য চাই আলাদা চ্যানেল
গিয়াস উদ্দিন সেলিম, নির্মাতা
টেলিভিশনের দর্শক আরো ১০-১২ বছর আগেই হারিয়েছে। মূল কারণ, টেলিভিশন চ্যানেল সম্পূর্ণভাবে চলে গিয়েছিল করপোরেট জগতের হাতে। নব্বইয়ের দশকে দেখেছি, বিটিভিতে পিক আওয়ারের এক মিনিটের বিজ্ঞাপনের মূল্য ছিল লাখ টাকার কাছাকাছি। পরে স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো সহজ করতে গিয়ে ত্রিশ হাজারে নামিয়ে আনে। ফলে বিজ্ঞাপনের হার এতই বাড়তে থাকে যে মনে হতো বিজ্ঞাপনের ফাঁকে ফাঁকে নাটক বা বিভিন্ন অনুষ্ঠান প্রচারিত হতো। ফলে দর্শক মুখ ফিরিয়ে নেয়। চ্যানেলগুলোর দূরদর্শী কোনো পরিকল্পনা ছিল না, নগদ লাভের আশায় এ কাজটা করত। আরেকটা ব্যাপার হলো, একমাত্র আমাদের দেশেই পে চ্যানেলের রীতি চালু নেই।
অনুষ্ঠান ও সংবাদ বিভাগকে স্বাধীনতা দিতে হবে
দীপংকর দীপন নির্মাতা
টেলিভিশনের দর্শক কমে গেছে—এভাবে সরলীকরণ করাটা ঠিক হবে না। আমাদের চিহ্নিত করতে হবে কোন কোন অনুষ্ঠানে দর্শক আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। প্রথমেই আসে ‘সংবাদ’-এর কথা। দর্শক যদি দেখে চ্যানেল একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর হয়ে কথা বলছে। সত্য প্রকাশ করে না, নিরপেক্ষতা বজায় রাখছে না, চারপাশে যা ঘটছে বা দেখছে তার প্রতিফলন সংবাদে ঘটছে না—তখন স্বাভাবিকভাবেই দর্শক সংবাদ দেখা বন্ধ করে দেবে। এরপর আসে ফিকশন বা নাটকের কথা। বিশ্বব্যাপী টেলিভিশনে যে ড্রামা বা সিরিয়াল দেখি, তার থেকে বেরিয়ে এসেছে বাংলাদেশের চ্যানেলগুলো। ব্যতিক্রম কিছু বাদ দিলে পৃথিবীজুড়ে হালকাবোধের গল্পই বেশি প্রচারিত হয়। এখানে হয়েছে উল্টো, সিনেমা নির্মাণের প্রতিবন্ধকতা থাকায় বেশি গভীর বা জটিল গল্পগুলো প্রচারিত হচ্ছে টিভিতে। আমাদের দেশের নারীরা এ ধরনের গল্প তেমন পছন্দ করেন না, যার কারণে তাঁরা ভারতীয় চ্যানেলের দিকে ঝুঁকে যান। সেখানেও দেখা যায় তাদের যে প্রতিদিনের যে সিরিয়াল, তার গল্প ঘুরেফিরে একই বৃত্তে আটকে থাকে। তাই বুদ্ধিবৃত্তিক মহিলারা ভারতীয় সিরিয়াল থেকে সরে এলেও এখনো অনেক দর্শক তাদের সিরিয়াল দেখে। তা ছাড়া এই সব সিরিয়াল প্রথম থেকে না দেখলেও বুঝতে অসুবিধা হয় না। অন্যদিকে আমাদের দেশের ধারাবাহিকের গল্প একেবারে শুরু থেকে না দেখলে বুঝতে অসুবিধা হয়। এর বাইরে এক ঘণ্টা দৈর্ঘ্যের যে নাটক, এটা কিন্তু বাংলাদেশেরই আবিষ্কার। স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের মতো করে টিভিতে গল্প বলা। একসময় টেলিভিশনে এর দারুণ চাহিদা ছিল সত্য, কিন্তু সহজলভ্য হওয়ার কারণে বাজেট কমে যেতে শুরু করে। তাতে ভালো গল্পের নাটকের নির্মাণ কমে যায়। যদিও ইউটিউব আসার পর এক ঘণ্টার নাটক আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে, সেখানে ভালো বাজেট পাচ্ছেন নির্মাতারা। টেলিভিশন নাটকের কিন্তু বাজেট সেভাবে বাড়েনি।