অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যে বিষয়গুলো সংস্কারের জন্য কমিশন গঠন করেছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো নির্বাচন কমিশন, নির্বাচনী আইন এবং নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার সংস্কার। এ কমিশনগুলোয় যাঁদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, কমিশনের প্রধানসহ বেশির ভাগ সদস্য সংশ্লিষ্ট কাজের জন্য যোগ্যতম ব্যক্তি—এতে কোনো সন্দেহ নেই।
আমার জানামতে, এরই মধ্যে কাজ অনেক দূর এগিয়েছে। এ বিষয়গুলো নিয়ে ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি সেমিনার বা আলোচনা সভাও অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ রকম সেমিনার বা আলোচনা সভার দু-একটিতে আমি উপস্থিত ছিলাম এবং এ বিষয়ে আমার কিছু মতামত তুলে ধরেছিলাম। সেসব বিষয় পত্রিকার পাঠকদের কাছে তুলে ধরার চেষ্টায় আমার আজকের এই সংক্ষিপ্ত আলোচনা।
নির্বাচন কমিশন, নির্বাচনী আইন এবং নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার সংস্কার নিয়ে প্রথম যে বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেটি হলো, নির্বাচন কমিশন গঠনপ্রক্রিয়া। আমাদের অনেকেরই মনে থাকার কথা, ২০২২ সালের আগে কোনো ধরনের আইন ছাড়াই নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে। মূলত ক্ষমতাসীন সরকারের পছন্দ-অপছন্দের তালিকা অনুসারে তখন নির্বাচন কমিশন গঠিত হতো। এমনকি ২০২২ সালের আগে রাষ্ট্রপতির নির্দেশ একটি ‘সার্চ কমিটি’ গঠিত হলেও তার ফলাফল ছিল ‘রাতের ভোটের’ নির্বাচন কমিশন।
পরবর্তী সময়ে কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বে যে কমিশন গঠিত হয়, তারাও একটি প্রহসনের নির্বাচন উপহার দেয়। ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত এই নির্বাচন ছিল প্রায় ভোটারবিহীন। অবস্থাদৃষ্টে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়, সেই নির্বাচন কমিশন ভোটের হার বাড়িয়ে দেখিয়েছিল। তারা দেশবাসীর সঙ্গে প্রতারণা করেছিল, যা নিয়ে দেশে-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনা হয়।
২০১৪ সাল থেকে ক্রমাগত অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনগুলোর মাধ্যমে দেশে চরম স্বৈরাচারী-ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েম হয়। এর পরিণতিতেই জুলাই-আগস্টে গণ-অভ্যুত্থানের ঘটনা ঘটল। দেড় দশক ধরে আওয়ামী লীগ সরকার কঠোর হাতে দেশ শাসন করেছে। কিন্তু গণ-অভ্যুত্থানের মুখে তাঁরা দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন। বর্তমানে তাঁদের অনেককেই আইনের হাতে সোপর্দ করা হয়েছে এবং তাঁদের বিচারের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
এ বিষয়ে আমার আগের লেখাগুলোতে স্পষ্ট করেই বলেছি, অগ্রহণযোগ্য ও ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে যে সরকার গঠিত হয়, সেই সরকারকে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় ‘হাইব্রিড’ গণতন্ত্র বা কথিত নির্বাচনের মাধ্যমে ‘স্বৈরতন্ত্র’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। এই তত্ত্ব প্রমাণে বেশি দূর যেতে হয়নি; শেখ হাসিনার গত এক যুগের শাসন এবং গণ-অভ্যুত্থানে তাঁর পতনের ঘটনাই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এই তত্ত্বের প্রমাণ। লাখ লাখ মানুষের রাস্তায় নেমে আসা এবং হাজার হাজার মানুষের আত্মদানের মধ্য দিয়ে স্বৈরতন্ত্রের পতন একটি ঐতিহাসিক ঘটনা।
কাজেই সর্বজনীন ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। গ্রহণযোগ্য, বিশ্বাসযোগ্য এবং স্বেচ্ছায় ভোটার উপস্থিতির দ্বারা নির্বাচনের মাধ্যমেই জবাবদিহিমূলক সরকার গঠিত হতে হবে। এ জন্য গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিবর্গ দ্বারা গঠিত নির্বাচন কমিশনের বিকল্প নেই।
সময়ের স্বল্পতার কারণে এবারও সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তবে কমিশন গঠনে একটি আইনের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। যেহেতু এখন নির্বাচনবিষয়ক একটি সংস্কার কমিশন গঠিত হয়েছে, সেহেতু আমি মনে করি এ-সংক্রান্ত আইনটি প্রথমে অধ্যাদেশ আকারে জারি করে আগামী কমিশন গঠন করা যেত।
এই আইন প্রণয়নের বিষয়টি বহুবার বহুভাবে অনেকই লিখেছেন। আইনের দ্বারা যথাযথ পদ্ধতি অনুসরণ করে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হলে সেটা স্বাভাবিকভাবেই অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য হওয়ার কথা। এ প্রক্রিয়ায় সংসদের ভেতরের রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি অন্যান্য দলের অংশগ্রহণের সুযোগ রাখা উচিত।
কমিশন গঠনপ্রক্রিয়ার বাইরেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ সংক্ষেপে আলোচনা করা দরকার। ইদানীং নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় আমূল পরিবর্তন আনার বিতর্ক তৈরি হয়েছে। সন্দেহ নেই, বাংলাদেশ অলিখিতভাবে দ্বিদলীয় রাজনীতিতে বিভক্ত। বিগত নির্বাচনগুলোর ফলাফল ও সরকার গঠনের ক্ষেত্রে এমনটাই দেখা গেছে। বিশেষ করে, ১৯৯০-এর পর থেকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের পর এই প্রবণতা লক্ষণীয়।