ক্ষমতা এমন এক বায়বীয় বস্তু, যার প্রতি রয়েছে মানুষের দুর্নিবার আকর্ষণ। এর কারণটি অবোধ্য নয়। ক্ষমতার জাদুর কাঠি যাঁর হস্তগত হয়েছে এবং যিনি তার সঠিক ব্যবহার করতে পারেন, তাঁর ভাগ্যের চাকা ঘুরতে সময় লাগে না। বিশেষ করে আমাদের দেশে রাজনৈতিক ক্ষমতার শক্তি অপরিসীম। এ চাবি হাতে থাকলে একদিকে যেমন ‘আলী বাবা চল্লিশ চোরের’ রত্নভান্ডারের সন্ধান পাওয়া যায়, তেমনি সমাজে নিজেকে ‘সম্মানীয়’ হিসেবেও উপস্থাপন করা যায়। রাজনৈতিক ক্ষমতার ছায়াতলে যিনি ঠাঁই পান, তাঁর মাথার ওপর তা থাকে ছায়াবৃক্ষ হয়ে। আমার এক বন্ধু রাজনীতিকে তুলনা করেছেন শিশুদের দেওয়া ভ্যাকসিনের সঙ্গে। দুই বছর বয়সের শিশুদের ওইসব ভ্যাকসিন দিলে কঠিন ছয়টি রোগ থেকে তারা মুক্ত থাকে সারা জীবন। যেমন পোলিও, হাম, ডিফথেরিয়া, হুপিং কাশি ইত্যাদি। তেমনি কেউ যদি রাজনীতিকে ঠিকভাবে অবলম্বন করতে পারে, তাহলে তিনিও মারাত্মক কয়েকটি রোগ থেকে মুক্ত থাকতে পারেন। তবে সে জন্য তাঁকে হতে হয় কৌশলী এবং বাতাস বুঝে পাল খাটাতে জানতে হয়।
একটি কথা আমাদের সমাজে বেশ প্রচলিত। ক্ষমতা ও অর্থের গরম সবাই নাকি সহ্য করতে পারে না। অর্থবিত্তে ফুলেফেঁপে ওঠা কেউ কেউ ধরাকে সরা জ্ঞান করে যা খুশি করে বেড়ান। তেমনি রাজনৈতিক ক্ষমতা হস্তগত হলে কেউ কেউ বনে যান মত্তহাতি। সবাইকে পদতলে পিষ্ট করার চেষ্টা করেন। বলা বাহুল্য, এই দুই ক্ষমতাবানদের বেশির ভাগই সময়ের ফেরে বিপাকে পড়েন। যখন অর্থবিত্তের প্রবাহ কমে যায়, কিংবা ক্ষমতার খুঁটি হয়ে পড়ে নড়বড়ে, তাঁরা বলবান থেকে হীনবলে পরিণত হন। উদাহরণ তো চোখের সামনেই রয়েছে। গত ৫ আগস্ট যে সরকারটির পতন ঘটল, সে সরকারের মন্ত্রী, দলের এমপি, নেতা, পাতিনেতা, হাফনেতা, নেতার হাতাদের ক্ষমতার অপব্যবহার কিংবা যথেচ্ছ ব্যবহার কি আমরা দেখিনি? কিন্তু এখন সেইসব নেতা-হাতাদের টিকিটিরও সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। কেমন যেন ভোজবাজির মতো তাঁরা হাওয়ায় মিলিয়ে গেছেন। যে বাড়ি বা বাসভবনগুলো এই সেদিনও ছিল কোলাহলমুখর, নেতা-কর্মী নামের হরেকরকম পাখিদের কিচিরমিচির কান ঝালাপালা করে দিত, এখন সেসব জায়গায় বিরাজ করছে সুনসান নীরবতা।
ক্ষমতার অপব্যবহারের প্রকারভেদ ও তার উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন সদ্য পতিত সরকারি দলটির নেতা-কর্মীরা। পতিত আওয়ামী লীগের ভাগ্যে যা ঘটেছে তা অভিনব কিছু নয়। এটাই প্রকৃতির বিধান। কেননা, প্রকৃতি নাকি পাপের ভার সইতে পারে না। অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি প্রকৃতিকে রুষ্ট করে এবং একসময় তা বিপর্যয় হয়ে নেমে আসে তাদের ওপর, যারা ক্ষমতা বা অন্য কিছুর ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি পর্যায়ের আচরণ করে। পবিত্র আল কোরআনে আল্লাহ রাব্বুল আল আমিন এরশাদ করেছেন ‘তোমরা সীমা লঙ্ঘন কোরো না, আমি (আল্লাহ) সীমা লঙ্ঘনকারীকে পছন্দ করি না।’
৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর একটি বড় রাজনৈতিক দলের কতিপয় নেতা-কর্মীর মধ্যে ক্ষমতার দাপট দেখানোর প্রবণতা সংক্রামক ব্যাধির মতো এতটাই ছড়িয়ে পড়েছে যে দলটির হাইকমান্ড কঠোর অবস্থানে গিয়েও তাঁদের নিবৃত্ত করতে পারছে না। দীর্ঘ ১৫ বছর আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের চাঁদাবাজি, লুণ্ঠন, দখলবাজির বিরুদ্ধে গলা ফাটিয়ে বক্তৃতা দিয়েছেন যাঁরা, তাঁরাই আজ নাম লেখাচ্ছেন সেসব অপকর্মের খাতায়। এ জন্য কেন্দ্রীয় পদস্থ নেতাসহ স্থানীয় মিলিয়ে এক হাজারেরও বেশি নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে দলটিকে শোকজ, সাময়িক বহিষ্কার, বহিষ্কার, পদাবনতি, সদস্যপদ স্থগিত ইত্যাদি ব্যবস্থা নিতে হয়েছে। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের পতনের পর ৬ আগস্ট বরিশালে বিএনপির কেন্দ্রীয় এক নেত্রী কর্তৃক অবৈধভাবে একটি পুকুর দখলের মধ্য দিয়ে যার শুরু, তার আপাত সর্বশেষ ঘটনা ঢাকার হাতিরঝিল থানার মহানগর আবাসিক এলাকায় একজন সংবাদমাধ্যমকর্মীকে পিটিয়ে হত্যা। সেই হত্যার নেপথ্যে রয়েছেন বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও আবাসন ব্যবসায়ী রবিউল আলম রবি। যিনি ২০১৮ সালের নির্বাচনে রাজধানীর একটি আসন থেকে দলটির মনোনয়ন পেয়েছিলেন।