হাসিনার দুঃশাসনের মাপকাঠিতে বঙ্গবন্ধুকে বিচার করা ঠিক হবে না

ডেইলি স্টার মাহফুজ আনাম প্রকাশিত: ১৮ অক্টোবর ২০২৪, ১৮:৪৪

সাম্প্রতিক দুটি ঘোষণা আমাদের আশ্চর্য করেছে। প্রথমত, আটটি জাতীয় দিবস বাতিল এবং দ্বিতীয়ত, উপদেষ্টা নাহিদের বক্তব্য, 'অন্তর্বর্তী সরকার শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পিতা হিসেবে বিবেচনা করে না।'


জাতীয় দিবস বাতিলের বিষয়ে সরকারের সঙ্গে আমাদের মতামত প্রায় একই। তবে, দ্বিমত রয়েছে তিনটি দিবস নিয়ে—৭ মার্চ (বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের দিনটি), ১৫ আগস্ট (বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের প্রায় সব সদস্যকে হত্যাকাণ্ডের দিন) এবং ৪ নভেম্বর (গণপরিষদে যেদিন সংবিধান গৃহীত হয়)। এই দিনগুলোতে ইতিহাস রচিত হয়েছিল এবং কোনোভাবেই এগুলোর গুরুত্ব কমানো উচিত নয়।


আমাদের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর অবদান অবিস্মরণীয়। তিনি আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সর্বোচ্চ নেতা। মওলানা ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, এ কে ফজলুল হক, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, জেনারেল ওসমানীসহ আরও অনেকেরই অবদান রয়েছে এই সংগ্রামে। নিজ নিজ অবদান অনুযায়ী ইতিহাসের পাতায় তাদের অবিস্মরণীয় অবদান ইতোমধ্যেই স্বীকৃত।


আমাদের মতে, বঙ্গবন্ধুর অবদান দুটি পর্যায়ে বিচার করা উচিত। প্রথম, স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত এবং দ্বিতীয়, ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তিনি দেশের ফিরে আসার পর। প্রথম পর্যায়ে তরুণ বয়স থেকেই তিনি বাঙালির অধিকার নিয়ে আন্দোলন করেছেন এবং পরবর্তীকালে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেছেন। এ ক্ষেত্রে তার অবদান অনস্বীকার্য। তিনি সমগ্র বাঙালি জাতিকে অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অধিকার আদায়ে ঐক্যবদ্ধ করেছেন। নিজেদের অধিকারের বিষয়ে সচেতন হওয়া, সেটা দাবি করা এবং প্রয়োজনে সেই দাবি আদায়ের জন্য সংগ্রাম করার আত্মবিশ্বাস তিনি আমাদের মধ্যে এনে দেন। সর্বমোট ১৩ বছর কারাবন্দি থাকলেও তিনি কখনোই আপস করেননি। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় তাকে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মুখপাত্রে পরিণত করে। স্বাধীনতা অর্জনের মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্ব অসামান্য সাহস ও সততার সঙ্গে পালন করেছেন। পাকিস্তানি শাসকের শৃঙ্খল থেকে আমাদের মুক্ত করার যে সংগ্রাম তা তিনি আজীবন করে গেছেন, তাতে কোনো দ্বিমত পোষণের সুযোগ নেই। তিনিই সেই নেতা, যিনি হিংস্র ও বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আমাদেরকে অস্ত্র ধরার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। তার সেই অবিস্মরণীয় বাণী, 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম' সর্বস্তরের সাধারণ বাঙালিদের হৃদয়ে প্রতিধ্বনিত হয়েছে। তিনিই আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা।



কিন্তু তিনি দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দেন—বিশেষত, একটি গণতান্ত্রিক নীতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। রক্ষীবাহিনী গঠন এবং রাজনৈতিক ফায়দা লোটার জন্য এই বাহিনীর ব্যবহার সবসময়ই সমালোচিত হয়েছে। কিন্তু মূলত যে কারণে তার ভাবমূর্তি ও সম্মানহানি হয়েছে সেটা হলো, ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে একদলীয় শাসন কায়েম করা। সেটাই ছিল স্বাধীন বাংলাদেশে স্বৈরাচারী শাসনের সূচনা।


এমন অনেক নেতাই আছেন, যারা বিপ্লবে সফল হলেও জাতি গঠনে কিছুক্ষেত্রে গুরুতর ভুল করেছেন। তারা এমন সব ভুল করেছেন, যা দেশের মানুষের জন্য অবর্ণনীয় দুঃখ, দুর্দশা, এমনকি তাদের মৃত্যুর কারণও হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক্ষেত্রে চীনের মহান নেতা মাও সেতুংয়ের কথা মনে পড়ে। তার পুরোটা জীবন কেটেছে দেশের মানুষকে ভালোবেসে, তাদের জন্য সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ করে। কিন্তু পরবর্তীতে তার 'গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ড' ও 'কালচারাল রেভ্যুলেশন' নীতি বাস্তবায়নের ফলে অগণিত মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে এবং বুদ্ধিবৃত্তিক নিপীড়ন হয়েছে। অন্যান্য বিশ্বনেতার এমন অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। বঙ্গবন্ধুও অনেক ভুল করেছেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ অন্যান্য ব্যক্তিদের মতো তাকেও সামগ্রিকভাবে মূল্যায়ন করতে হবে।


সবচেয়ে ভালো হবে, যদি যোগ্য ইতিহাসবিদদেরকে এই কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়—রাজনীতি সংশ্লিষ্টদের নয়।


আমরা কোনোক্ষেত্রেই যেন শেখ হাসিনার আদ্যোপান্ত ত্রুটিপূর্ণ, অগণতান্ত্রিক, জনস্বার্থবিরোধী, দুর্নীতিগ্রস্ত, ক্ষমতালোভী, অসহিষ্ণু ও ফ্যাসিবাদী শাসনের পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধুর অবদান মূল্যায়ন না করি। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষদের ঐক্যবদ্ধ করা, আইয়ুববিরোধী গণআন্দোলন গড়ে তোলা, ছয় দফা দাবি তোলা, ১৯৭০ সালের নির্বাচনের বিস্ময়কর ফলাফল অর্জন, ৭ই মার্চের ভাষণ এবং ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে শুরু করে অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে কার্যত তৎকালীন পাকিস্তান সরকারকে অকার্যকর করে দেওয়া আমাদের ইতিহাসের গৌরবময় মুহূর্তগুলোর অন্যতম, যা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ও অবিসংবাদিত ভূমিকার কারণে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই জনমানুষ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা—বিশেষত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা (অনেকটাই সাম্প্রতিক সময়ের মতো)—অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। কিন্তু এর সবই সম্ভব হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর পাহাড়সম ব্যক্তিত্ব, উপস্থিতি ও দ্ব্যর্থহীন নেতৃত্বের কারণে। গত সাড়ে ১৫ বছরে শেখ হাসিনা যা করেছেন, সেটা বিবেচনা করে বঙ্গবন্ধুর এসব ভূমিকাকে আমরা কোনোভাবেই ছোট করে দেখতে পারি না।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন
ট্রেন্ডিং

সংবাদ সূত্র

News

The Largest News Aggregator
in Bengali Language

Email: [email protected]

Follow us