মানুষ যখনই বিপদে পড়েছে, অসহায় অনুভব করেছে, কখনই কোনো এক কল্পিত শক্তির কাছে পরিত্রাণ চেয়েছে। নিজের কল্যাণকামনায় এবং অপশক্তি বধে মানুষ যুগে যুগে নানা দেব-দেবীর কল্পনা করেছে। দুর্গাও তেমনই এক দেবী। হিন্দু পুরাণ অনুসারে, দুর্গা যেমন অসুরবিনাশী দেবী, তেমনি তিনি দুর্গতিনাশিনী, যিনি জীবের দুর্গতি নাশ করেন। দেবী দুর্গা অসুরদের দলপতি মহিষাসুরকে বধ করে দেবকুলকে রক্ষা করেছিলেন। তার এই জয়ের মধ্য দিয়ে অশুভ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় ও শুভশক্তির জয় হয়েছিল।
পুরাণ মতে, ‘দুর্গম’ নামে এক অসুর ছিল। তার কাজ ছিল জীবজগতের জন্য দুর্গতি সৃষ্টি করা। যে দেবী সেই দুর্গম অসুরকে বধ করে স্বর্গ থেকে বিতাড়িত দেবতাদের হারানো রাজ্য ফিরিয়ে দিয়েছিলেন এবং জীবজগৎকে চিরকাল দুর্গতির হাত থেকে রক্ষা করেন, তিনিই দুর্গা। ভারতবর্ষের বাঙালি হিন্দু মানসে দুর্গা প্রতিবাদের দেবী, প্রতিরোধের দেবী। একই সঙ্গে তিনি ‘মাতৃরূপেণ’ ও ‘শক্তিরূপেণ’। এ উৎসব শরৎকালে উদ্যাপিত হয় বলে এটিকে শারদীয় দুর্গোৎসবও বলা হয়।
দেবীর দুর্গার শুরু কোথায়? দেবীর ইতিহাস কি? সেই প্রাচীন যুগে দেবীর কনসেপ্টটা এলো কোথা থেকে? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া অত্যন্ত কঠিন। দেবী দুর্গার ঘটনা সবচেয়ে বিশদ ভাবে লেখা মার্কণ্ডেয় পুরাণের ‘দেবী-মাহাত্ম্যে’ (যাকে শ্রীশ্রী চণ্ডী বলা হয়)। অন্য সব পুরাণে দেবীকে পাওয়া যায় অন্যভাবে!
তবে দুর্গা— এই নামটি শুনলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে যে দেবীমূর্তি, তার দশ হাতে দশ রকম অস্ত্র, এক পা সিংহের পিঠে, এক পা অসুরের কাঁধে। তাকে ঘিরে থাকেন গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী আর কার্তিক ঠাকুর। যারা সেকেলে নিয়মে প্রতিমা বানান, তাদের প্রতিমার পেছনে চালচিত্রে আরও নানারকম ঠাকুরদেবতার ছবিও আঁকা থাকে। আর যারা আধুনিক, তারা প্রতিমার মাথার উপর একখানা ক্যালেন্ডারের শিবঠাকুর ঝুলিয়ে রাখেন। মোটামুটি এই মূর্তি বছরের পর বছর ধরে দেখে আমরা অভ্যস্ত।
বর্তমানে যে শারদীয় দুর্গোৎসব অনুষ্ঠিত হয়, এই উৎসবকে অনেকে রামায়ণে বর্ণিত দুর্গা পূজার রূপ বলে মনে করেন। মা দুর্গার অকালবোধন এবং এর রামায়ণ যোগ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক। অযোধ্যাপতি রাম ছিলেন ভগবান বিষ্ণুর সপ্তম অবতার। ১৪ বছর বনবাসকালে তার স্ত্রী সীতাকে দৈত্যরাজ রাবণ অপহরণ করেন। রাবণের কবল থেকে সীতাকে মুক্ত করার জন্য রাম দৈত্য রাজা বধ করার সিদ্ধান্ত নেন। ভগবান রামচন্দ্র রাবণের প্রাণনাশে সাফল্য অর্জনের জন্য দেবী দুর্গার কৃপা কামনা করেন ও সেজন্য তিনি আদ্যাশক্তি দেবী দুর্গার আরাধনা করেন। ঐতিহ্যগতভাবে দেবী দুর্গা বসন্ত ঋতুতে পূজিত হতেন। কিন্তু যুদ্ধের কারণে রামচন্দ্র শরৎ ঋতুতে দেবীর আশীর্বাদের জন্য প্রার্থনা করেন। যদিও শরৎকাল দেবদেবীদের ঘুমের সময় বলেই পরিচিত। কারণ, এসময় দিন ছোট ও রাত বড় হয় এবং রাত সাধারণত রাক্ষস জাতির পরিচায়ক বলে গণ্য করা হয়।
প্রথা অনুযায়ী দেবী দুর্গার অষ্টমীবিহিত সন্ধিপূজায় ১০৮টি নীল পদ্মের প্রয়োজন হয়, কিন্তু অনেক চেষ্টার পরেও রামচন্দ্র শুধু ১০৭টি পদ্মের ব্যবস্থা করতে পেরেছিলেন। এসময় নিরুপায় হয়ে তিনি ১০৮তম পদ্মস্বরূপ তার নিজের চোখ উপড়ে নিতে উদ্যত হন। কথিত আছে যে, পতিতপাবন রামের চোখকে নীল পদ্মের সঙ্গে তুলনা করা হত বলে তার অপর নাম ছিল ‘পদ্মলোচন’। যাহোক, মা দুর্গা রামের একনিষ্ঠতা দেখে খুশি হয়ে স্বয়ং রামের সামনে আবির্ভূতা হন এবং দৈত্যরাজ রাবণকে যুদ্ধে পরাজিত করার জন্য রামচন্দ্রকে আশীর্বাদ করেন। মা দুর্গার এই অসময়ে আবাহন বাংলায় ‘অকালবোধন’ হিসাবে পরিচিত হয়। তারপর থেকেই শরৎকালে দেবী দুর্গার পূজা প্রচলিত হয়। শরৎকালীন দুর্গাপূজা শারদোৎসব নামে পরিচিত হয় এবং সমস্ত বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চলে বৃহদাকারে পালিত হয়। বসন্তকালীন দুর্গাপূজা বাসন্তী পূজা নামে পরিচিত যা ঐতিহ্যগতভাবে মূল দুর্গাপূজা হলেও শারদীয় দুর্গাপূজা উদযাপনের উন্মাদনায় তা প্রায় হারিয়ে গেছে।