ড. মুহাম্মদ ইউনূস আপনাকে শুভেচ্ছা। দুই মাস হয়নি আপনি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নিয়েছেন। একদম নতুন সময়, একদম নতুন দায়িত্ব, যেটা হয়তো আগে কখনো ভাবেননি। এই দায়িত্ব আপনার কেমন লাগছে? আপনি কেমন আছেন?
ড. মুহাম্মদ ইউনূস: আছি। ভালো আছি। একটা নতুন দায়িত্ব। বড় দায়িত্ব। দায়িত্ব সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছি। হঠাৎ করে যে একটা দায়িত্ব এল, সেটা বহন করার মতো যোগ্যতা অর্জন করা, সেটাকে কাজে পরিণত করতে সচেষ্ট আছি।
আমরা জানি যে দুই দশক ধরে আপনাকে অনেক গালাগাল শুনতে হয়েছে। আদালতের বারান্দায় বারান্দায় ঘুরতে হয়েছে। পদ্মার পানিতে আপনাকে চুবানোর কথাও হয়েছে। আপনার তো জেলে যাওয়ার কথা, হয়তো এ সময় আপনার জেলে থাকার কথা ছিল। হঠাৎ করে সবকিছু বদলে গেল। আপনিই এখন রাষ্ট্র পরিচালনায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন। একটা অবাক করা, অদ্ভুত ও বিস্ময়কর পরিবর্তন। এমন কিছু যে হতে পারে, আপনি কি কখনো ভেবেছিলেন?
ড. ইউনূস: এটা একটা নতুন অভিজ্ঞতার মতো। আমি দুদিন আগে জেলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। আদালতের দরজায় দরজায় ঘুরছিলাম। হঠাৎ করে জেলে না গিয়ে আমি বঙ্গভবনে গিয়ে শপথ গ্রহণ করলাম। একেবারে উল্টো একটা অবাক চিত্র। অতীতেও এ রকম আহ্বান জানানো হয়েছিল আমাকে। সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য। মাফ চেয়েছি বরাবর। এটা কোনো দিন সিরিয়াসলি ভাবিনি যে দায়িত্ব নিতে হবে। এবার ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিস্থিতি। এ জন্য দায়িত্বও নিয়েছি।
আপনি কীভাবে এই বিরাট পরিবর্তনের সঙ্গে যুক্ত হলেন। ছাত্রনেতাদের সঙ্গে আপনার যোগাযোগটা কীভাবে হলো? আপনি কোন পর্যায়ে এসে সম্মতি দিলেন?
ড. ইউনূস: ছাত্রনেতাদের সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ ছিল না। পত্রিকায় টেলিভিশনের নিউজে তাঁদের দেখছিলাম। বরাবর যেভাবে আন্দোলন হয়, এভাবেই দেখছিলাম। আমি তখন বিদেশে ছিলাম যখন এই আন্দোলন ঘনীভূত হচ্ছিল। প্যারিস অলিম্পিকে একটা দায়িত্ব পালন করছিলাম। ওটার ডিজাইনিংয়ে আমি ইনভলভড ছিলাম। এ সময়ে আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে। সেই সময় প্যারিসের একটা রাস্তার নাম আমার নামে নামকরণ করা হয়েছিল, সেটার উদ্বোধন করেছিলাম। কাজেই আমি এদিকে দেখছি, ওই দিকেও দেখছি, দূরের দৃশ্য হিসেবে।
আমার অফিস থেকে আমার সঙ্গে যারা যোগাযোগ রাখে তারা বলছিল: ‘স্যার এখন ফিরবেন না, এখন অবস্থা ভালো না। এলেই বোধ হয় আপনাকে জেলে নিয়ে যাবে। আপনি একটু দূরে থাকেন। পরিস্থিতি বুঝে আপনাকে বলব, কখন আসতে হবে।’ কাজেই আমি পরিকল্পনা করছিলাম বার্লিনে যাব, বার্লিনের পর রোমে যাব। তারপর ব্রাজিল যাব ইত্যাদি। দেশে ফিরে আসব এবং এ রকম একটা দায়িত্ব নিতে হবে, এটা একদম মাথায় ছিল না। এ সময় ছাত্রদের একজন আমার অফিসকে জানাল যে আমার সঙ্গে আলাপ করতে চায়। ছাত্রদের কথা এই প্রথম শুনলাম। জানতে চাইলাম, কী আলাপ করতে চায়। তখন আমাকে জানানো হলো, আপনাকে সরকারের দায়িত্ব নিতে হবে। আমি বললাম, এটা তো ভিন্ন কথা। তাকে বললাম, তোমার সঙ্গে আলাপ হয়েছে? সে জানাল, আলাপ হয়েছে। আমি বললাম, ঠিক আছে আমিও আলাপ করি, কী বলে দেখি। সে যোগাযোগ করিয়ে দিল, আমি আলাপ করলাম। তাদের বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে আমাকে এই দায়িত্ব দিয়ো না। বরাবরই আমি এই দায়িত্ব থেকে দূরে সরে থেকেছি। এই দায়িত্ব নেওয়া ঠিক হবে না। তোমরা অন্য একজন ভালো করে খুঁজে দেখো। তারা বলল, না স্যার আর কেউ নেই। আপনাকেই দায়িত্ব নিতে হবে। আমি তাদের আবার বললাম, তোমরা খোঁজ করো। খোঁজ করার পর আমাকে বলো, কী দাঁড়াল। তখন সে আমাকে জানাল, ঠিক আছে স্যার, কাল আপনাকে জানাব। পরদিন আবার সে ফোন করল। সে জানাল, স্যার, উপায় নেই। আপনাকেই আসতে হবে। আপনাকে দায়িত্ব নিতে হবে। অবিলম্বে আসতে হবে।
আমি তখন জানালাম, আমি তো এখন হাসপাতালে। আমি তো অত তাড়াতাড়ি আসতে পারছি না। আমি ডাক্তারের সঙ্গে আলাপ করে দেখি, কী বলেন উনি। তবে তোমরা যখন এত প্রাণ দিয়েছ এবং বলছ যে আমাকে দায়িত্ব নিতে হবে, যতই আমার আপত্তি থাকুক, আমি এ ব্যাপারে সম্মতি দিলাম। তবে আমি ডাক্তারের সঙ্গে আলাপ করে বলতে পারব, আমি কখন আসতে পারব। সে বলল, না স্যার, আপনাকে তাড়াতাড়ি আসতে হবে। আমি হাসপাতালে ডাক্তারের সঙ্গে আলাপ করলাম। ডাক্তার বললেন, আপনার তো আগামী দিনও হাসপাতালে থাকার কথা। আমরা চেষ্টা করি আপনাকে আগামীকাল ছেড়ে দিতে পারি কি না। পরদিন সকালে ওঠার পর ডাক্তার বললেন যে আপনি চাইলে চলে যেতে পারেন। ডাক্তার ছেড়ে দিলেন। আমি দেশে চলে এলাম।
এই সিদ্ধান্ত তো আপনি নিলেন। ছাত্রনেতারা ছাড়া বাইরের আর কারও সঙ্গে কি আপনার পরামর্শ করার সুযোগ হয়েছিল?
ড. ইউনূস: আর কে যে আছে, তা–ও তো আমি জানি না। আমার কিছু জানা ছিল না।
ছাত্রনেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক...
ড. ইউনূস: এদের কারও সঙ্গে কোনো রকম সম্পর্ক ছিল না। তারা কারা, ঢাকায় এসে তাদের চেহারা আমি দেখেছি। তাদের সঙ্গে কথা হলো। এয়ারপোর্টে তারা ছিল। তখন তাদের সঙ্গে পরিচয় হলো।
আপনি দেশের একটা সংকটময় পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নিয়েছিলেন, দুই মাস আগে। সময়টা ছিল যথেষ্ট ঘটনাবহুল। সময়টা কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
ড. ইউনূস: একেবারে দ্রুতগতিতে সবকিছু ঘটেছে। আমি ফিরে এলাম। সেদিন রাতেই শপথ গ্রহণ করলাম। সব ওলট–পালট। দেশে ফিরে এসে কোথায় জেলে যাব, এখন অন্য দিকে চলে গেলাম! কী করতে হবে? এরা কারা? শপথ গ্রহণে কারা কারা থাকবে? সবকিছুই নতুন! সবকিছু ভিন্ন পরিস্থিতি। তবু মনে করলাম দায়িত্ব যখন তারা নিতে বলেছে, আমি রাজি হয়েছি, কাজেই আমি সে দায়িত্ব পালন করব। এভাবেই একটা অপরিচিত জগতের মধ্যে অপরিচিত সঙ্গী নিয়ে আমার যাত্রা শুরু হলো।