শান্তিতে নোবেলজয়ী ডেসমন্ড টুটুর কথা দিয়েই শুরু করি। তিনি বলেছিলেন, ভালোবাসা ও সহমর্মিতা সম্প্রীতির ভিত্তি। বাংলাদেশ ঐতিহাসিকভাবেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। আবহমানকাল ধরে এ দেশে বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষ পারস্পরিক সম্প্রীতি বজায় রেখে বসবাস করে আসছে। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনে একক ও সক্রিয়ভাবে যে উপাদান কাজ করেছে, সেটি হলো আমাদের অসাম্প্রদায়িক চেতনার শক্তি।
গত ২৭ আগস্ট বিবিসি বাংলায় ‘বাংলাদেশে ক্ষমতার পরিবর্তন ঘিরে হিন্দুদের বারবার শঙ্কায় পড়তে হয় কেন?’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ক্ষমতার পটপরিবর্তনে সঙ্গে সঙ্গে সংখ্যালঘু, বিশেষ করে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের নিরাপত্তার বিষয়টি বেশ স্পর্শকাতর হয়ে ওঠে বলে গণমাধ্যমটির সংবাদে বলা হয়।
১৯৪৭ সাল থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত এই ভূখণ্ডে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর যেসব বড় সংগঠিত হামলা হয়েছে, তার কারণ যেমন রাজনৈতিক, আবার সাম্প্রদায়িকও। সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে আমাদের জনগোষ্ঠীর—ক্ষুদ্র হলেও—একটা অংশের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ আছে বলেই সেটাকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা সম্ভব হয়।
গত আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পটপরিবর্তনে ৫ আগস্টের পরপর দেশের বিভিন্ন জায়গায় ধর্মীয় সংখ্যালঘু, বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর বহু হামলার ঘটনা ঘটেছে। কোথাও বাড়িঘরে, কোথাও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে, কোথাও উপাসনালয়ে হামলা-ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। দেশের প্রথম সারির একটি গণমাধ্যম গত ৫ থেকে ২০ আগস্ট পর্যন্ত অনুসন্ধান চালিয়ে হামলায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অন্তত ১ হাজার ৬৮টি ঘরবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার তথ্য পেয়েছে। এর বাইরে হামলা হয়েছে ২২টি উপাসনালয়ে। সনাতন ধর্মাবলম্বী ছাড়াও হামলা হয়েছে খ্রিষ্টান, আহমদিয়া সম্প্রদায়, সাঁওতালসহ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ওপর।
দেশের সর্বোচ্চ আইন, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান এ বিষয়ে অর্থাৎ নাগরিকের অধিকার বিষয়ে সুস্পষ্ট। ২৭ নম্বর অনুচ্ছেদে আইনের দৃষ্টিতে সব নাগরিকের সমতা, ২৮ অনুচ্ছেদে ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী–পুরুষ বা জন্মস্থানভেদে নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্রের কোনো বৈষম্য প্রদর্শনের বিরুদ্ধে স্পষ্ট উচ্চারণ রয়েছে। সুতরাং কোনো ধরনের সাম্প্রদায়িকতা অবশ্যই বৈষম্যের একটি চিত্র, যা মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী। এই প্রেক্ষাপটে এ বছর অক্টোবর মাসের প্রথমাংশে অনুষ্ঠিত হবে বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপূজা। দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে কোথাও প্রতিমা ভাঙচুর, কোথাও সংখ্যালঘু নির্যাতনের সংবাদও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশন সব মানুষের মানবাধিকার নিশ্চিতকরণের উদ্যোগ গ্রহণে আইনি ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত। মানবাধিকার কমিশনের প্রত্যাশা হলো, ধর্মবর্ণ–নির্বিশেষে সব মানুষের মানবাধিকার সমুন্নত ও নির্বিঘ্ন থাকবে। কমিশন মনে করে, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে, ধর্মীয় ও জাতিগতভাবে জনসংখ্যায় সংখ্যালঘুর অস্তিত্ব আছে, যদিও কমিশন লঘু বা গুরুর বদলে সমনাগরিকতায় বিশ্বাস স্থাপন করে। সবাইকে সমান নাগরিক হিসেবে বিবেচনা করে। এ ক্ষেত্রে কমিশনের অভিমত হলো, বাংলাদেশের নাগরিক হয়েও কেউ যদি অসহায় বোধ করেন, তাহলে দেশের মানবাধিকার সংরক্ষণ বাধাগ্রস্ত হবে।
আসন্ন দুর্গাপূজায় দেশের ৩২ হাজার ৬৬৬টি মণ্ডপে পূজা উদ্যাপিত হবে। মণ্ডপগুলোয় যথাযথ নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি বলে কমিশন মনে করে। তবে এ ক্ষেত্রে সমাজের সবার আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করা বাঞ্ছনীয়। দুর্গাপূজাকে ঘিরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সংস্কৃতি গড়ে তোলার জন্য যেসব নিয়ম-নীতি ও ব্যবস্থা গ্রহণ সমীচীন, তার মধ্যে রয়েছে:
১. সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে ধর্মীয় উসকানির জন্য যারা ব্যবহার করে, তাদের সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রাখতে হবে এবং এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনে আইনি বিধানগত সংস্কার করতে হবে।
২. বৈষম্যবিরোধী ছাত্র–জনতার আন্দোলন ও রাজনৈতিক পটপরিবর্তনকালে সহিংসতায় বিপুলসংখ্যক স্থাপনার ক্ষয়ক্ষতি এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য আক্রান্ত ও হতাহত হন। ঘটনার আকস্মিকতায় বিহব্বল হয়ে তাঁদের মধ্যেও খানিকটা স্থবিরতা, মনোবল ভেঙে পড়া ও ক্ষেত্রবিশেষে নিষ্ক্রিয়তা পরিলক্ষিত হয়। অতএব দেশব্যাপী বিশালসংখ্যক পূজামণ্ডপে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালনে তাঁদের সক্ষমতা যাচাই করে উপযুক্ত করে তোলা বা সহযোগী শক্তি গঠনের মাধ্যমে দায়িত্ব প্রতিপালনে যত্নবান হতে হবে।