জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের উপস্থিতি এবং অধিবেশনের ফাঁকে যা যা হয়েছে তার গুরুত্ব বিচার করলে বলা যায়, বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্কে একটি নতুন ও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো, নেদারল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ডিক স্কফ, ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট (তিনি আসতে পারেননি) ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার বাকি প্রতিটি দেশের সরকার প্রধান, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন, জাতিসংঘের মহাসচিবসহ অনেক বিশ্বনেতা ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার সাক্ষাৎ এটাই ইঙ্গিত করছে যে, বৈশ্বিক অবস্থানে বাংলাদেশ নাটকীয়ভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) মতো বহুপাক্ষিক ঋণদাতা সংস্থার প্রধানরা দ্রুততম সময়ে আমাদের সহযোগিতা দিতে এবং দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে সার্বিকভাবে কার্যকরী সহযোগিতা দিতে সম্মত হয়েছেন। এ থেকে বোঝা যায় যে আমাদের সঙ্গে বৈশ্বিক ঋণদাতাদের সম্পর্কের উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়নবিষয়ক সংস্থা (ইউএসএআইডি) নতুন করে বাংলাদেশের প্রতি আগ্রহ দেখিয়ে ইতোমধ্যে ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ দিয়েছে। সবমিলিয়ে বলা যায়, বিশ্বনেতাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কে সুস্পষ্ট উন্নয়ন হয়েছে।
আমাদের সরকার প্রধান একজন নোবেলজয়ী হওয়ায় এই জায়গায় সুস্পষ্ট ব্যবধান তৈরি হয়েছে, যেখানে সাবেকদের কেউ ছিলেন সামরিক বাহিনী থেকে উঠে আসা একনায়ক আবার কেউবা ক্ষমতালোভী রাজনীতিবিদ। ড. ইউনূস শুধু বাংলাদেশেই নয়, বরং সামগ্রিকভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলোর নেতৃত্বকে নতুন এক সম্মানের জায়গায় নিয়ে গেছেন। এমন সর্বশেষ নেতা ছিলেন নেলসন ম্যান্ডেলা। তবে ম্যান্ডেলার মতো ড. ইউনূস তার জীবনের ২৭ বছর কারাগারে কাটাননি বা আজীবন বর্ণবাদী শাসকের অধীনে থেকে শোষণের শিকারও হননি। তবে তিনি তার পুরোটা জীবন দরিদ্রদের সেবা করেছেন এবং ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচির মাধ্যমে তাদেরকে দারিদ্র্য থেকে বের করে এনেছেন।
দরিদ্রদের ভাগ্য পরিবর্তনে ড. ইউনূসের এই কর্মসূচির কেন্দ্রে ছিলেন নারীরা। তার মডেলটি এখন অসংখ্য উন্নয়নশীল দেশে অনুসরণ করা হচ্ছে, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রসহ কিছু উন্নত দেশও এটি অনুসরণ করছে। সেখানে গ্রামীণ ব্যাংকের অনুকরণে তৈরি প্রতিষ্ঠান দরিদ্রদের ওপর উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে, বিশেষত শহরকেন্দ্রিক দরিদ্রদের।
বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের নতুন করে ফিরে পাওয়া এই অবস্থানের ভূরাজনৈতিক প্রভাব এখনো ধোঁয়াশা ও অনিশ্চয়তায় ঘেরা। উল্লসিত হওয়ার মতো বিষয়গুলোকে এক পাশে রাখলে প্রশ্ন জাগে, যুক্তরাষ্ট্র তথা বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গে বাংলাদেশের এই নতুন ঘনিষ্ঠতার স্থায়িত্ব নিয়ে আমরা ঠিক কতটা আত্মবিশ্বাসী হতে পারি, যেখানে তাদেরই মেয়াদ শেষ হতে যাচ্ছে জানুয়ারিতে? রিপাবলিকানদের কাছে ড. ইউনূসের গুরুত্ব কতটা? রিপাবলিকানরা মার্কিন নির্বাচনে জিতে গেলেও কি ঢাকা-ওয়াশিংটনের এই বন্ধুত্ব অটুট থাকবে? প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস হেরে গেলে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে আমরা যে ধরনের সহায়তা পাওয়ার আশা করছি তার অনেকটাই ভেস্তে যেতে পারে। তবে এটা নিঃসন্দেহে বলতে হবে যে ড. ইউনূসের এই সফরের অন্যান্য প্রাপ্তিগুলোকে যুক্তরাষ্ট্রের এই সমীকরণের সঙ্গে মেলানো নিষ্প্রোয়জন।
বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী দেশ ভারত ও চীন আমাদের নতুন বাস্তবতার সঙ্গে কীভাবে মানিয়ে নেয়, সেদিকেও আমাদেরকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বৈঠকের জন্য লিখিতভাবে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল ঢাকা। কিন্তু, তাদের নিউইয়র্ক যাওয়া-আসার তারিখ না মেলায় এই বৈঠক আয়োজন সম্ভব হয়নি। যার ফলে একটি অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতির উদ্ভব হয় এবং আমাদের নেতা মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট, নেপাল ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করলেও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী দেশ ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে পারেননি।
তবে, আমাদের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের বৈঠক হয়েছে এবং আপাতদৃষ্টিতে সেটা ভালো ভাবেই শেষ হয়েছে বলে ধারণা করছি। তবে এই বৈঠক কতটুকু অর্থবহ হয়েছে, তা সময়ই বলে দেবে।