খবরটা শুধু বিস্ময়করই নয় বরং সাম্প্রতিক বছরগুলোয় উন্নয়ন প্রকল্পের নামে কীভাবে জনঅর্থের অপচয় হয়েছে এবং বাংলাদেশকে কীভাবে একটি ‘প্রকল্পরাষ্ট্রে’ পরিণত করা হয়েছিল, তার একটি বড় উদাহরণ এই সংবাদ।
বিবিসি বাংলার একটি খবরে বলা হয়েছে, কোটা সংস্কার আন্দোলন চলার সময় হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত রাজধানীর কাজীপাড়া ও মিরপুর-১০ মেট্রো স্টেশন সংস্কার করতে একশো কোটি টাকা লাগবে বলা হলেও ডিএমটিসিএলের নবনিযুক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবদুর রউফ জানিয়েছেন, কাজীপাড়া স্টেশন সংস্কারে ১ কোটি টাকারও কম খরচ হবে। মিরপুর-১০ স্টেশনের যন্ত্রপাতি আমদানির কারণে কিছুটা বেশি খরচ হবে, তবে প্রকৃত খরচ এখনও নির্ধারিত হয়নি।
প্রসঙ্গত, গত ১৯ জুলাই হামলার পর দুই স্টেশন মেরামত করতে প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা খরচ হতে পারে বলে ডিএমটিসিএলের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল। এমনকি সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও তখন বলেছিলেন, ‘মেট্রোরেলের কাজীপাড়া ও মিরপুর ১০ স্টেশন ধ্বংসপ্রাপ্ত। এক বছরেও যন্ত্রপাতি এনে সচল করা সম্ভব হবে না।’
অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর অন্য অনেক প্রতিষ্ঠানের মতো মেট্রোরেলের পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালককেও সরিয়ে দেওয়া হয়। নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবদুর রউফ বলেছেন, স্থানীয়ভাবে যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করে দ্রুত কাজ এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। কাজীপাড়া স্টেশন এই মাসেই চালু হতে পারে।
উন্নয়নকে প্রশ্ন করা
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশের অবকাঠামো খাতে যে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে, তা নিয়ে দ্বিমতের সুযোগ কম। যেমন পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ইত্যাদি। কিন্তু এইসব উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয়িত অর্থের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি কতটা নিশ্চিত করা গেছে; বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়ন যেমন রাস্তা, সেতু, কালভার্ট ও অন্যান্য নির্মাণকাজের ব্যয় কেন অনেক বেশি— ওই প্রশ্নগুলোও জনমনে ছিল, আছে। কিন্তু এসব প্রশ্নের খুব সদুত্তর মেলেনি। আবার গণমাধ্যমও সব সময় এইসব প্রশ্ন খুব নির্ভয়ে ও নির্মোহভাবে উত্থাপন করেনি বা করতে পারেনি। কেননা প্রশ্ন করাকেও ‘উন্নয়নবিরোধিতা’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বরং এইসব উন্নয়নের প্রশংসাসূচক খবর ও বিশ্লেষণই বেশি হয়েছে এবং এই ধরনের সাংবাদিকতাকেই বলা হয়েছে ‘উন্নয়ন সাংবাদিকতা’। বাস্তবতা হলো উন্নয়নকে প্রশ্ন করার নামই উন্নয়ন সাংবাদিকতা।
মেট্রোরেলের এই ঘটনাটি অনেকগুলো প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। যেমন, যারা বলেছিলেন যে এই দুটি স্টেশনের সংস্কার কাজে সাড়ে তিনশো কোটি টাকা লাগবে, তারা কীসের ভিত্তিতে এই হিসাব দিয়েছিলেন? এখন কীভাবে একশো কোটি টাকার কাজ মাত্র এক কোটি টাকায় করা যাচ্ছে? এটি কি উন্নয়ন প্রকল্পের নামে জনঅর্থের অপচয়ের একটি বড় উদাহরণ? এখন কি সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাস্তবায়িত সবগুলো বড় প্রকল্পের অর্থ খরচ নিয়ে তদন্ত ও অনুসন্ধান হবে?
যেদিন জানা গেল একশো কোটি টাকার কাজ এক কোটিতে হচ্ছে, তার দিন দুয়েক পরই ১৮ সেপ্টেম্বর ভোর থেকে ১১ ঘণ্টারও বেশি সময় বন্ধ ছিল মেট্রোরেল। গণমাধ্যমের খবর বলছে, মেট্রোরেলের ফার্মগেট স্টেশনের পরে ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালের সামনের একটি পিলারের ওপরের ভায়াডাক্টের চারটি স্প্রিং থেকে একটি স্প্রিং সরে গেছে। এতে রেলপথের একটি অংশের ভায়াডাক্ট দেবে গিয়ে আগারগাঁও-মতিঝিল রুটে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু একটি নতুন লাইনে কেন এই পরিস্থিতি তৈরি হলো? উদ্বোধনের দেড় বছরের মাথায় কী করে এত বড় একটি ত্রুটি দেখা দিল? এটি কি নিতান্তই দুর্ঘটনা, টেকনিক্যাল ফল্ট নাকি নির্মাণ ত্রুটি? যদি নির্মাণ ত্রুটি হয় কিংবা যন্ত্রপাতি ত্রুটিপূর্ণ হয়, তাহলে মেট্রোরেলের নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানকেও জবাবদিহির মধ্যে আনতে হবে।
চুক্তি অনুযায়ী সব যন্ত্রপাতি ঠিকঠাক দেওয়া হয়েছে কিনা; না হলে কোথায় কোথায় গলদ; এই মানের একটি মেট্রো লাইন চালু করতে উন্নত বিশ্ব এবং এবং প্রতিবেশী ভারতে কী পরিমাণ টাকা খরচ হয় আর বাংলাদেশে কত হয়েছে— এসব প্রশ্নও জনমনে আছে। যদি ভারতের চেয়ে অনেক বেশি খরচ হয়, তাহলে ওই বাড়তি খরচের খাতগুলো কী কী এবং সেগুলো কতটা যৌক্তিক— সেটিও জনগণের জানা উচিত।
শুধু দেশের ঠিকাদার ও ইঞ্জিনিয়ারদেরই ‘চোর’ বলে গালি দেওয়া হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এ পর্যন্ত যতগুলো বড় প্রকল্পের সঙ্গে বিদেশি প্রতিষ্ঠান, ইঞ্জিনিয়ার ও ঠিকাদার জড়িত— তার সবগুলো প্রকল্প নিয়েই এখন তদন্ত হওয়া প্রয়োজন যে, ওইসব প্রকল্পে কী পরিমাণ ফাঁকিবাজি হয়েছে এবং কী পরিমাণ চুরি হয়েছে।
বিদেশিরা ধোয়া তুলসিপাতা কিনা— সেটি জানার অধিকার দেশবাসীর আছে। আর যদি তদন্তে বেরিয়ে আসে যে সত্যিই প্রতিটি প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে, তাহলে এই অনুসন্ধানও তখন করতে হবে এইসব অনিয়মের সঙ্গে কারা কারা জড়িত।
দুর্নীতি ও অনিয়মনের অভিযোগের তীর বরাবর রাজনীতিবিদদের দিকেই থাকে। কিন্তু বলাই হয়, রাষ্ট্রীয় প্রতিটি অন্যায় ও চুরির পেছনে অন্তত একজন আমলার হাত থাকে। কিন্তু তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যান। কিন্তু এখন এই বাস্তবতারও অবসান হওয়া প্রয়োজন।