‘ব্যাংকের ৯৫ শতাংশ আমানতকারী সম্পূর্ণ নিরাপদ: গভর্নর’—এই হচ্ছে খবরের শিরোনাম। বড়ই স্বস্তিদায়ক খবর। স্বস্তিদায়ক এই কারণে যে বেশ কিছুদিন যাবৎই ব্যাংকের আমানত নিয়ে নানা কথা হচ্ছে। বিশেষ করে ব্যাংকের টাকা লুট হওয়ার প্রেক্ষাপটে। ব্যাংকের টাকা লুটের সঙ্গে সম্পর্কিত ঋণখেলাপি সমস্যাটা দীর্ঘদিনের। দিনে দিনে এই সমস্যা তীব্র হয়েছে। সরকার পরিবর্তন হয়েছে। নতুন সরকার গঠিত হয়েছে এক মাসের ওপর হলো। এই প্রেক্ষাপটে নানা নতুন সমস্যা, সম্ভাবনা ইত্যাদির আলোচনা সামনে আসছে। অনেক ব্যাংকের বোর্ড ভেঙে নতুন বোর্ড গঠিত হয়েছে। ব্যাংকিংয়ের ওপর টাস্কফোর্স গঠিত হবে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে। নিয়ম-কানুনে পরিবর্তন আসছে।
প্রচুর আশাবাদ প্রতিদিন প্রকাশিত হচ্ছে। সাবধান বাণীও আছে। বোঝাই যায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেতৃত্বে একটা বড় ধরনের পরিবর্তন হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় বড় খবর এল আমানতকারীদের স্বার্থ সম্পর্কে। কোত্থেকে? বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে। এই ব্যাংকটির প্রধান কাজই হলো আমানতকারীদের স্বার্থ দেখা, সুবিধা-অসুবিধা দেখা। শুধু স্বার্থই নয়, সেবা নিশ্চিত করাও তাদের কাজ। এই কাজের ফাঁকেই তারা অন্য কাজ করে। যেমন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। এই দুই কাজই প্রধান। যদিও এ ক্ষেত্রে তাদের অবদান বহুদিন থেকেই প্রশ্নবিদ্ধ। আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষায় তারা অমনোযোগী, তাঁদের সেবা সুনিশ্চিত করার ক্ষেত্রে তারা উদাসীন।
সব ব্যাংক তদারকি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংককে তদারকিতে রাখার কোনো ব্যবস্থা নেই। তাদের ব্যর্থতা যে দেশের সর্বনাশ ডেকে আনছে, এই প্রশ্নও কেউ করে না। আলোচনা শুধু ঋণখেলাপ সমস্যা, বড় বড় জালিয়াতি। অথচ কেউ প্রশ্ন করে না কেন একটা সুস্থ-সবল দক্ষ কেন্দ্রীয় ব্যাংক থাকা সত্ত্বেও দেশের ব্যাংকিংব্যবস্থা এমন একটা নাজুক অবস্থায় পৌঁছাল। এমনই প্রেক্ষাপটে ভালো খবর দিলেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। তিনি বললেন, ব্যাংকের ৯৫ শতাংশ আমানতকারী সম্পূর্ণ নিরাপদ। এর চেয়ে উত্তম আশাবাদ আর হয় না। কারণ, ৯৫ শতাংশ আমানতকারীর বাইরে রয়েছেন আরও ৫ শতাংশ। তাঁদের আমানতের খবর কী?
আরও প্রশ্ন—৯৫ শতাংশ আমানতকারীর আমানত দেশের মোট আমানতের কত অংশ? আর ৫ শতাংশ আমানতকারীর আমানত দেশের মোট আমানতের কত অংশ? আমার কাছে সর্বশেষ তথ্য নেই, তবে বোধগম্য যে বড় বড় আমানতের পরিমাণই বেশি। ছোট ছোট আমানতের বরকত বেশি। এরাই ‘কোর’ আমানতকারী। কিন্তু সিংহভাগ আমানত হচ্ছে বড় বড় আমানত। বর্তমান ক্ষেত্রে ২ লাখ টাকার ওপরের আমানত। এখন পর্যন্ত ব্যাংকে যাঁরা ১ লাখ টাকা পর্যন্ত আমানত রেখেছেন, তাঁদের আমানত বিমার মাধ্যমে সুরক্ষিত। এখন থেকে তা হবে ২ লাখ টাকা। অর্থাৎ কোনো ব্যাংক যদি ‘লাল বাতি’ জ্বালায়, তাহলে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত যাঁদের আমানত আছে, তাঁরা তাঁদের পুরো টাকা ফেরত পেয়ে যাবেন। ভালো খবর।
কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, ২ লাখ টাকার ওপরে যাঁরা আমানত রেখেছেন তাঁদের টাকা কী হবে? এই প্রশ্নটি এখন জরুরি এই কারণে যে বাংলাদেশ ব্যাংকই বলছে, গোটা দশেক ব্যাংক নাকি ইতিমধ্যেই দেউলিয়া অথবা দেউলিয়া হওয়ার পথে। খুবই উদ্বেগজনক খবর। কারণ ৫ শতাংশ আমানতকারীর সিংহভাগ টাকা দিয়েই ব্যাংকিং খাত চলছে। ঋণ যেমন বড় বড়, আপাতত বড় বড়। বাজার অর্থনীতির ফল আরকি! এই অর্থনীতিতে বড়রাই বড় হবে, ছোটরা পেছনে পড়বে। এটাই নিয়তি। এখন প্রশ্ন, সিংহভাগ আমানতের (ডিপোজিট) গ্যারান্টি কী? এই সম্পর্কে কোনো অনিশ্চিত বাণী সমূহ ক্ষতি বয়ে আনবে। অতএব পরিষ্কার ভাষায় বলা দরকার, তাঁদের আমানতও নিরাপদ। দুই অর্থ হতে পারে, এমন কোনো বক্তব্য এই মুহূর্তে কাম্য নয়—আশা করি বিষয়টি গভর্নর মহোদয় বোঝেন।