জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলার সময়ে শেখ হাসিনা মাঝেমধ্যে সকালের দিকে প্রেসক্লাবে আসতেন। এসে আমাকে বলতেন চা খাওয়ান। বলা বাহুল্য, তখন তাঁর প্রিয় সাংবাদিকদের একজন ছিলাম। খুব স্পষ্ট করেই তাঁকে বলেছিলাম, আমি তাঁর দলের রাজনীতি সমর্থন করি না। সম্পর্কটা একদম পেশাদারি।
অমন এক সকালে প্রেসক্লাবে এসেছিলেন শেখ হাসিনা। বড় ঘরটার সামনের দিকে দরজার পাশে প্রথম টেবিলটায় আমরা বসে ছিলাম। চা খেতে খেতে তিনি বললেন, একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। জানালেন, ৩২ নম্বর সড়কে মুজিবের বাসভবনকে জাদুঘর বানাতে চান। হয়তো তিনি আশা করেছিলেন বিশেষ খবর হিসেবে বিচিত্রায় প্রতিবেদন লিখব। যা হোক, কথাটা শুনে একটু ধন্দ লেগেছিল। জিজ্ঞেস করলাম, ওটা ডিআইটি/রাজউকের আবাসিক এলাকার প্লট। সরকার সেখানে জাদুঘর বানাতে দেবে? তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, সেটা ঠিক করে এসেছি।’
উইকিপিডিয়া থেকে জানা যায়, পূর্ব পাকিস্তানের শিল্পমন্ত্রী থাকাকালে শেখ মুজিব ধানমন্ডির প্লটটির জন্য আবেদন করেছিলেন। ১৯৫৮ সালে সরকার ছয় হাজার রুপি দামের প্লটটি তাঁকে বরাদ্দ দেয়। ১৯৬০-এ কারামুক্ত হয়ে তিনি ওই প্লটটিতে একতলা বাড়ি বানিয়ে দুই কামরায় বাস করতে থাকেন। (বিস্তারিত ইতিহাস হয়তো Bangabandhumuseum.org.bd-এ পাওয়া যেত। ওয়েবসাইটটি বর্তমানে বন্ধ।)
ধন্দ ছিল প্লটটি আবাসিক বলে নয়, জাদুঘর বানানোর চেষ্টার কারণে। সন্দেহ হয়েছিল, এই উদ্যোগের মধ্যে ঐতিহাসিক ঘটনা নিজের স্বার্থে ব্যবহারের চেষ্টা আছে কি না। অনেক ইতিহাস তাত্ত্বিক মনে করেন, কোনো ঐতিহাসিক ঘটনার ইতিহাস তিন পুরুষের কেউ লিখতে গেলে তা আর ইতিহাস থাকে না।
ইতিহাসেই প্রমাণ পাওয়া যায় রাজা-বাদশাহ, রাজনৈতিক নেতারা নিজের ভাস্কর্য নির্মাণ থেকে শুরু করে ফরমায়েশি জীবনী রচনা করে আর যা হোক ইতিহাস লেখেননি। বঙ্গবন্ধু জাদুঘর যে অন্তত কিছু মানুষের কাছে তীর্থ ও রাজনৈতিক কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল, তা আশা করি আওয়ামী লীগের সমর্থকেরাও স্বীকার করবেন।
তাহলে ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী, অংশগ্রহণকারী ও প্রেরণাদানকারীরা জীবিত থাকতেই, আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে গণ-অভ্যুত্থানের এক মাস পার হতেই গণভবনে জাদুঘর বানানোর উদ্যোগ কি ঠিক হচ্ছে? ইতিহাস কী তাহলে বিজয়ীর হাতেই রচিত হচ্ছে?
প্রচলিত বাক্যটি চার্চিলের নামে চালানো হয়। ব্লগার শুভম জৈনের দাবি, এর উৎস এখনো অজ্ঞাত। এর মূল অর্থ বিজয়ীর লেখা ইতিহাস সত্যনির্ভর নয়। তিনি লিখেছেন, ইতিহাস লেখে প্রত্যেকে, সঠিক উদ্ধৃতি হওয়া উচিত, ‘যারা কোনো ঘটনা থেকে সুবিধা পায়, স্বল্প সময়ের জন্য তারা ইতিহাস বিকৃত করে।’