ট্রেনলাইনের সামনে ইয়ারফোন কানে গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে এক তরুণ। দূরে দেখা যাচ্ছে ট্রেন। সবকিছু ঘটছে খুব দ্রুত। জীবনের প্রশ্ন; আর তার জন্য সিদ্ধান্তটাও নিতে হবে তাড়াতাড়ি। এমন পরিস্থিতিতে ডাকাডাকি করেই হোক আর ধাক্কা দিয়ে, তরুণকে লাইন থেকে সরাবেন আপনি। আপনার জায়গায় যে কেউ হোক না কেন, এটাই করবে। এমনকি ইয়ারফোন কানে রাখা তরুণের জায়গায় একটা গরু বসে থাকলেও। এমন সিদ্ধান্তের পেছনে প্রাচ্য কিংবা পাশ্চাত্যের কোনো আদর্শ নিহিত নেই। ওই তরুণ কিংবা আপনি নিজে কোন ধর্মের, বর্ণের, কিংবা আদতে মানুষ নাকি অন্য প্রাণী; এমন জিজ্ঞাসাও ওঠে না। জীবন বাঁচানোই কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। অর্থাৎ আগে অস্তিত্বের প্রশ্ন; তারপর সমস্ত আদর্শিক বিষয়। এটাই মোটাদাগে আদর্শ ও অস্তিত্বের ফারাক। এমন এক উত্তরণ, যখন অস্তিত্ব নিয়েই সম্পর্কের বোঝাপড়া তৈরি হয়। আর যখন অস্তিত্বের প্রশ্ন এগিয়ে আসে তখন আদর্শিক জটিলতা খুব একটা হালে পানি পায় না।
দেড় দশকের স্বৈরতন্ত্র শেষে নতুন করে নিশ্বাস নিতে পারছে বাংলাদেশ। দেখা দিয়েছে ‘কতিপয়ের দেশ’ থেকে ‘গণমানুষের দেশ’ হয়ে ওঠার সুযোগ। দারুণ কিছু লক্ষণ এর মধ্যেই সামনে এসেছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মাঠে অনুপস্থিত থাকা সময়গুলোয় বয়স, লিঙ্গ, ধর্ম ও আদর্শ নির্বিশেষে কিশোর ও তরুণরা ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করেছেন। রাতে ডাকাতের হামলা থেকে পাহারা দিয়েছেন ঘরবাড়ি। সুরক্ষাপ্রাচীর তৈরি হয়েছে সংখ্যালঘুদের বাড়ির সামনে। বর্তমানে দেশ বন্যাকবলিত। হাজারো আশঙ্কার মধ্যে ইতিবাচক খবর হলো, বৌদ্ধ ভিক্ষুরা কাঁধে ত্রাণ নিয়ে কোমর সমান পানি মাড়িয়ে যাচ্ছেন বন্যার্তের সহযোগিতায়। আলেমরা তাদের অন্য কাজ পেছনে রেখে বন্যার্তদের জন্য এগিয়ে যাচ্ছেন তহবিল নিয়ে। সেই তহবিলে আবার দান করছেন হিন্দু জনগোষ্ঠী; তাও আবার দুর্গা পূজার জন্য জমিয়ে রাখা অর্থ। এমন দৃশ্য যেন বহুদিন কেউ দেখেনি। যেন প্রতিটা মানুষ দেশটাকে নিজের ভাবতে শুরু করেছে। যেন সত্যিই নতুন এক সমাজ ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে মানুষ; যেখানে আদর্শের ঊর্ধ্বে গিয়ে সমুন্নত হবে সাম্য, ন্যায়বিচার, অধিকার ও মানবিক মর্যাদা। এ কথা সত্য, প্রতিটি অভ্যুত্থানের পর নানা স্বপ্ন থাকে জনমনে। আশাভঙ্গের মতো ব্যাপার যে ঘটে না, তা না। সেটা পরের কথা। কিন্তু দীর্ঘ দুঃশাসনের পর এমন দৃশ্য যেন বাংলাদেশকে আরো বেশি মাটির কাছাকাছি নিয়েছে।
গড়পড়তা জীবনে মানুষ এমন বিশ্ব ব্যবস্থা দেখে অভ্যস্ত, যেখানে একটা আদর্শের মোকাবেলায় আরেকটা আদর্শকেই দাঁড় করানো হয়। বাংলাদেশও সেই পথে হেঁটেছে। গত দেড় দশকে চেতনার পক্ষের শক্তি ও বিরোধী শক্তি করে বিভাজন ও বৈষম্য জিইয়ে রাখা হয়েছে জাতির মধ্যে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কোনো আদর্শকে বাতিল করতে আরেকটা আদর্শ আনা কি সত্যিই প্রয়োজন? আরো সহজভাবে বললে ফ্যাসিজমের মোকাবেলা করতে কি আরেকটা ‘তন্ত্র’ আবিষ্কার করতেই হবে? কেন এতটুকুই যথেষ্ট নয় যে মানুষ ফ্যাসিজমে ক্লান্ত? মানুষের স্বাধীনতা দরকার বেঁচে থাকার জন্য। এজন্যই বুদ্ধিজীবী শ্রেণী যখন নয়া আদর্শের তালাশে ছিল তখন বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার জন্য আলাদা করে কোনো আদর্শিক পাটাতনের প্রয়োজন হয়নি। বরং এতটুকুই যথেষ্ট ছিল যে তারা স্বৈরাচারী আদর্শের প্রতি বীতশ্রদ্ধ। তারা চলমান বৈষম্য ও নিপীড়নের সমাপ্তি চায়। শহীদের তালিকা ঘেঁটে সব শ্রেণী, সব বয়স, সব ধর্ম ও জাতের মানুষ পাওয়া যায়। অর্থাৎ মিছিলে নামার আগে তাদের আদর্শিক পরিচয় জরুরি হয়নি। তাদের ঐক্যবদ্ধ করেছিল অস্তিত্বের প্রশ্ন। সেদিক থেকে দেখলে বাংলাদেশ যেন আদর্শোত্তর যুগে প্রবেশ করেছে অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে।
প্রতিটি অভ্যুত্থানের পরবর্তী কাজ হলো সেই সময়কে সংজ্ঞায়ন করা। সময়ের পরিবর্তন ও জনমানসের গতিপ্রকৃতি বুঝতে পারা। বাংলাদেশের সামনে বর্তমানে এমন একটা জায়গা হতে পারে সাম্প্রদায়িকতা-অসাম্প্রদায়িকতা প্রশ্ন। গত দেড় দশকে এখানকার রাজনৈতিক অভিধানে শব্দ দুটির প্রয়োগ মতলবপূর্ণ ছিল। সত্যি বলতে, ‘অসাম্প্রদায়িকতা’ শব্দটি নিজেই ‘সাম্প্রদায়িক’। কারণ ‘অসাম্প্রদায়িকতা’ শব্দ উপস্থিত মানে ‘সাম্প্রদায়িকতা’ উপস্থিত। দুটি শব্দই কেবল তাত্ত্বিক আলোচনার উপজীব্য মাত্র। যারা এ-বিষয়ক শহুরে বাহাসে লিপ্ত হয় তাদের কোনো পক্ষেই সে অর্থে ভিন্ন মতের সঙ্গে বসবাসের ব্যবহারিক অভিজ্ঞতা নেই। অথচ বাংলাদেশের গ্রাম অঞ্চলে আদিম আমল থেকেই বহু জাতের ও বর্ণের মানুষ বসবাস করে আসছে। একজন বৌদ্ধ ও মুসলমানের খেতের আইল কিংবা একজন হিন্দু ও মুসলমানের পাশাপাশি দোকান থাকা সাম্প্রদায়িক নাকি অসাম্প্রদায়িক সেটা কেউ দেখেনি। সমস্যা হয়নি পাশাপাশি চলাফেরা কিংবা বাজার করায়। ভিন্ন ধর্মে ও বর্ণে বন্ধু ও প্রতিবেশী থাকাটাকেও মনে করা হয়নি বিশেষ কিছু। টঙের দোকানে সালাম আর শ্যামল; কালাম আর কমলের আড্ডায় কোনো মার্ক্সীয়, মাওবাদী কিংবা ধর্মতত্ত্বীয় ব্যাকরণ প্রভাব রাখেনি। অথচ তাদের বৈঠক স্মরণাতীতকাল থেকেই প্রাণবন্ত।
এখনো অনেককে জিজ্ঞাসা করলে দেখা যাবে, তারা নিজেরাই জানে না ‘সাম্প্রদায়িক’ কিংবা ‘অসাম্প্রদায়িক’-এর মতো দাঁতভাঙা কঠিন শব্দ দিয়ে আসলে কী বোঝায়। যেমনটা বোঝে না ধর্মতন্ত্র কিংবা ধর্মনিরপেক্ষতা, শ্রেণী সংগ্রাম কিংবা শ্রেণী সুবিধা অথবা তেমন কোনো আদর্শ। অথচ এ বাংলাতেই কৃষকরা নজিরবিহীন প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন পলাশীর পর। অত্যাচারীর অপসারণ ও নিজেদের অধিকার আদায়ই মুখ্য ছিল বাংলার ইতিহাসের প্রতিটি শতকেই। মজনু শাহ ও ভবানী পাঠকের কথাই ধরা যাক। ‘সাম্প্রদায়িক’ কিংবা ‘অসাম্প্রদায়িক’ আলাপে তাদের আটকানো যায়নি। তারা কেবল সেটাই করেছেন, যেটা অস্তিত্বের জন্য প্রয়োজন ছিল। তারা একাট্টা ছিলেন ব্রিটিশ শাসনের সমাপ্তির জন্য। তাদের সাম্প্রদায়িক পরিচয় সংজ্ঞায়িত হয়েছে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও পরবর্তীকালের জাতীয়তাবাদীদের কলমে। একই রকম দৃশ্য ইতিহাসের আগের সময়গুলোয়ও দেখা যায়। সহাবস্থান ও সম্প্রীতিই এ জনপদের সত্যিকার পরিচয়। এখানে সাম্প্রদায়িকতা কিংবা অসাম্প্রদায়িকতার তাত্ত্বিক বাহাস আরোপিত।