বাংলাদেশের ইতিহাসে একসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদ ও সংসদের ক্ষমতাসীন দলের সদস্য এবং স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের ‘নির্বাচিত’ মেয়র-চেয়ারম্যান-কাউন্সিলর-সদস্যদের সবার ‘নাই’ হয়ে যাওয়ার নজির নেই। তাঁদের কেউ কেউ দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন, কেউ কেউ দেশেই আত্মগোপনে আছেন।
প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদনমতে (১৫ আগস্ট, ২০২৪), দেশের মোট ৬৪ জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের ৪৪ জন (৬৮.৭৫ %), ৪৯৫ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের মধ্যে ৩১৯ জন (৬৪.৪৪ %), ৩৩০ পৌর মেয়রের মধ্যে ২০৫ জন (৬২.১২ %) এবং ১২ জন সিটি মেয়রের মধ্যে ৯ জন (৭৫ %) আত্মগোপনে বা পলাতক অবস্থায় আছেন।
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণের দুই মেয়রসহ অনেকে বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন। দেশের ইউপি চেয়ারম্যানদেরও একই অবস্থা। অফিসগুলোতে প্রশাসনের লোকজনের উপস্থিতি থাকলেও তাঁরা ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থায় আছেন এবং উদ্যোগী হয়ে কাজ করছেন না।
এ রকম একটি পরিস্থিতি সামলানোর ব্যাপারে কারও কোনো পূর্বধারণা নেই। ফলে অন্তর্বর্তী সরকার বিপদে আছে। এ অবস্থা মোকাবিলায় জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও পৌরসভায় কর্মরত সরকারি কর্মকর্তাদের ‘আর্থিক ও প্রশাসনিক’ ক্ষমতা দিয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগ একটি অফিস আদেশ জারি করেছে। জন্ম-মৃত্যুনিবন্ধনসহ অন্যান্য কাজ জেলা প্রশাসক, ইউএনও এবং ডিডি-এলজি মনোনীত প্রতিনিধিরা করবেন—এ সিদ্ধান্ত হয়েছে।
আবার স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে পলাতক মেয়র, সভাপতি, কাউন্সিলর ও সদস্যদের অপসারণ এবং ‘প্রশাসক’ নিয়োগের বিষয়ে একটি অধ্যাদেশ জারি করে ইউনিয়ন পরিষদ বাদে সর্বত্র সরকারি কর্মকর্তাদের নিজ পদের অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়ে ‘প্রশাসক’ করা হয়েছে।
সিটি করপোরেশন ছাড়া অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে ‘প্রশাসক’ নিয়োগের বিধান বিদ্যমান আইনেই আছে। সিটি করপোরেশনের ক্ষেত্রে আইনের ৩টি ধারা ১৩, ২৫ ও ১০৮ পর্যালোচনা করে প্রশাসক নিয়োগের জন্য অধ্যাদেশ জারির বিষয় প্রাধান্য পেয়েছে। কিন্তু তাঁরা বোধ হয় ১৬ নম্বর ধারাটি বিবেচনায় নেননি।
স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নেতৃত্বশূন্যতা বা অচলাবস্থা নিরসন ও গণতান্ত্রিক উত্তরণের জন্য এ সন্ধিক্ষণে কী কী করা দরকার, সে বিষয়ে কিছু পরামর্শ দিতে চেয়েছিলাম। তার আগেই অধ্যাদেশ জারি হওয়ায় আমাদের চিন্তাভাবনাগুলো কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। তবু নিকট ভবিষ্যতে এ–জাতীয় সমস্যা ও সংকট আরও আসবে এবং মোকাবিলা করতে হবে বলে সাময়িকভাবে অপ্রাসঙ্গিক হলেও পরামর্শগুলো শুনে রাখা ভালো।
সরকারি কর্মকর্তাদের নানা দায়িত্ব দিয়ে ‘ঠেকা চালাতে’ গিয়ে নির্বাচনভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলোর গণতন্ত্রমুখী যাত্রাকে উল্টোমুখী করা ভালো পদক্ষেপ নয়। বিদ্যমান আইনেই যেসব ভালো বাস্তব বিকল্প আছে এবং অধ্যাদেশ না করেও যা নির্বাহী আদেশে করা সম্ভব, এমন বিষয়গুলো সম্পর্কে আলোকপাত করা প্রয়োজন। প্রথমে দ্বিধাহীন চিত্তে বলতে হয়, বাংলাদেশের সফল ‘জুলাই–আগস্ট অভ্যুত্থান’-এর স্থির লক্ষ্য সব প্রতিষ্ঠানের গণতান্ত্রিক উত্তরণ ও তার যথাযথ সুরক্ষা নিশ্চিত করা।
এ উত্তরণ সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারীবিবর্জিত কোনো ব্যবস্থা নয়। একটি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সুদক্ষ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী অপরিহার্য সহায়ক সম্পূরক ভূমিকা পালন করে থাকেন।
স্থানীয় সরকারের গণতান্ত্রিক উত্তরণেও সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারীরা যথাযথ ভূমিকা পালন করবেন। কিন্তু কখনো কোনো সংকটকাল উপস্থিত হলে নির্বাচিত ব্যবস্থার বিকল্প হিসেবে সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারীদের ওপর দায়িত্বভার অর্পণ তথা ‘প্রশাসক’ নিয়োগের উদ্যোগ ভ্রান্তিপ্রসূত চিন্তা বা চিন্তার দৈন্য। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে প্রাধান্য দিলে ভালো বিকল্প পাওয়ার অনেক পথ খোলা আছে।
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়বিষয়ক উপদেষ্টা একজন প্রথিতযশা আইনজ্ঞ ও রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা ছিলেন। তাঁর মতো প্রাজ্ঞ ব্যক্তিকে আমার মতো আইনে অজ্ঞ ব্যক্তির আইনের পরামর্শ দেওয়ার ধৃষ্টতা দেখানো অনুচিত। দীর্ঘদিনের স্থানীয় সরকারবিষয়ক অভিজ্ঞতার আলোকে তবু নিচে কিছু পরামর্শ তালিকাভুক্ত করা হলো।
১. পলাতক বা অনুপস্থিত স্থানীয় সরকার নেতাদের উপস্থিত হওয়ার জন্য অন্তত এক সপ্তাহের একটি সময়সীমা বেঁধে দেওয়া যেতে পারে। বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে যোগ না দিলে তাঁদের পদ কেন শূন্য ঘোষণা করা হবে না, এ মর্মে সরকার তাঁদের নোটিশ ইস্যু করতে পারে। প্রয়োজন মনে করলে উচ্চ আদালতের একটি নির্দেশনাও নেওয়া যেতে পারে। তারপর সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে এক–দেড় মাসের মধ্যে সব অনুপস্থিত ব্যক্তির পদ শূন্য ঘোষিত হতে পারে।
২. সাধারণভাবে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ নেতা বর্তমান অবস্থায়ও এলাকায় আছেন বা পরিষদে আসতে পারেন। তাঁদের উপস্থিতিকে সম্পূর্ণভাবে অবজ্ঞা করা যাবে না। বলা যেতে পারে, তাঁদের নির্বাচন সঠিক ছিল না, সেটি একটি ভিন্ন বিষয়। এ জন্য ভিন্নভাবে ব্যবস্থা নিতে হবে।