কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশপ্রেমিক ছাত্র-জনতা সরকারবিরোধী আন্দোলনে জেগে ওঠে। তাদের দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ রক্তঝরা গণঅভ্যুত্থানে রূপ নিলে স্বৈরাচারী সরকারপ্রধান বলপ্রয়োগের মাধ্যমে ক্ষমতা ধরে রাখতে চান। ফলে রক্ত ঝরে। প্রাণ যেতে থাকে ছাত্র-জনতার। তবে পরিস্থিতি অধিকতর বিস্ফোরণমুখী হলে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি করতে রাজি না হওয়ায় ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন। এরপর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। নবগঠিত সরকার দায়িত্বভার গ্রহণ করায় বিশৃঙ্খল প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে অগণতান্ত্রিক ও অজনপ্রিয় হাসিনা সরকার-সমর্থক কর্মকর্তারা পদত্যাগ করা শুরু করেন। অন্যদিকে, সরকার সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করে কাজ শুরু করে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অধিকাংশ উপাচার্য উপ-উপাচার্য পদত্যাগ করেন। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রক্টরিয়াল বডির সদস্য এবং আবাসিক হল প্রশাসনের প্রোভোস্ট-হাউজটিউটররাও পদত্যাগ করেন। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এক ধরনের অচল হয়ে পড়ে। এ কারণে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সচল করতে প্রথমে প্রতিষ্ঠানের প্রধান তথা উপাচার্য নিয়োগ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দেয়। এ কাজে সরকারের সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টা এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। কারণ, তারা যেমন উপাচার্য চান, বড় স্বায়ত্তশাসিত সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় তেমন উপাচার্য নিয়োগে প্রত্যাশিত ধরনের ব্যক্তিত্ব খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিন। এ জন্য সরকার এখন পর্যন্ত (২৩-০৮-২০২৪) বড় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটিতেও উপাচার্য নিয়োগ দিতে পারেনি। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় খুললেও শিক্ষা কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে।
সরকারি বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় কেন উপাচার্য নিয়োগে এত জটিলতা? এর পেছনে বিভিন্ন কারণ রয়েছে। বড় চারটি বিশ্ববিদ্যালয় চলে ১৯৭৩ সালের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ/আইন দ্বারা। এ আইনের কারণে দলসম্পৃক্ত শিক্ষকের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। বিরল ব্যতিক্রম ব্যতীত এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রায় সব শিক্ষক কোনো না কোনো বর্ণদলে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। এ ছাড়া এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিন নির্বাচন হয় শিক্ষকদের ভোটে। ডিন একাডেমিক পদ হওয়ায় অনেক যোগ্য শিক্ষক ডিন হতে ভোটে দাঁড়ান। এ নিয়ে প্রচারণা শুরু হলে শুরু হয় দলাদলি এবং কাদা ছোড়াছুড়ি। এর ফলে বিভিন্ন অনুষদে যারা ডিন হন, বা পরাজিত হয়ে ডিন হতে পারেন না, তাদের প্রত্যেকের গায়ে দলীয় রাজনীতির ছাপ লাগে।
ডিন নির্বাচনে সাধারণ শিক্ষকরা ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারলেও উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে তাদের মতামত গুরুত্ব পায় কম। কারণ, স্বায়ত্তশাসিত বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সিনেট সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত ৩ সদস্যের প্যানেল থেকে আচার্যের একজনকে উপাচার্য নিয়োগ দেওয়ার বিধান কদাচিৎ পালন করা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সরকার তার গুডবুকে অবস্থানকারী নতজানু কোনো পছন্দের শিক্ষককে উপাচার্য হিসাবে নিয়োগ দেয়। ফলে এমন নিয়োগে শিক্ষকদের পছন্দ প্রতিফলিত হয় না। যদি অধ্যাদেশ অনুযায়ী উপাচার্য নির্বাচন হতো, তাহলেও যারা উপাচার্য প্যানেলে ভোটের জন্য দাঁড়াতেন, তাদের শরীরেও লাগত দলীয় ছাপ। কারণ, নির্বাচনের মাধ্যমে যেসব পদে শিক্ষকদের অধিষ্ঠান হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো বর্ণদলের সমর্থন না নিয়ে তেমন পদে নির্বাচিত হওয়া শিক্ষকদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। এ কারণে সিনেট নির্বাচনে, উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনে যারা দাঁড়ান, তাদের প্রত্যেকের গায়ে বর্ণদলের ছাপ লাগে। এসব কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নির্দলীয় চরিত্রের শিক্ষক খুঁজে পাওয়া কঠিন।
আরও অনেক কারণে শিক্ষকরা বর্ণদলে সম্পৃক্ত হন। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সব রেমুনারেটিভ পদে নিয়োগ এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বণ্টিত হয় দলীয় বিবেচনায়। ফলে অধিকাংশ সময় শিক্ষকরা ক্ষমতাসীন দল প্রভাবিত বর্ণদলে সম্পৃক্ত থেকে এসব সুবিধা পেতে সচেষ্ট থাকেন। তারা জানেন, দলনিষ্ক্রিয় থাকলে এমন পদে নিয়োগ পাওয়া সম্ভব হবে না। তবে কেবল দলসক্রিয় হলেই যে এমন পদ পাওয়া যায়, তা নয়। কারণ, যেহেতু দলসক্রিয় শিক্ষকের সংখ্যা অনেক, সে কারণে তাদের মধ্যে পদ-পদবি পাওয়ার জন্য শুরু হয় অশুভ প্রতিযোগিতা। এ কারণে বিভিন্ন পদে লোকবল নিয়োগের ক্ষেত্রে যোগ্য এবং মেধার বিষয়টি অনেক ক্ষেত্রেই উপেক্ষিত হয়। রাষ্ট্রক্ষমতায় সরকারের পরিবর্তনের সঙ্গে অন্য বর্ণদলীয় শিক্ষকরা একই রীতিতে কাজকর্ম করেন। ফলে যদি এমন কোনো শিক্ষক থাকেন, যারা বর্ণদলে সম্পৃক্ত নন, তারা সব সময় উপেক্ষিতই থাকেন। তাদের কাজকর্ম শ্রেণিকক্ষেই আবদ্ধ থাকে।
উপাচার্য নিয়োগ পেতে ব্যবহৃত একটি বড় অস্ত্র হলো তদবির। অনেক প্রার্থী মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সচিব, সরকারঘনিষ্ঠ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, এমনকি প্রভাবশালী ছাত্র সংগঠনের নেতাদের কাছেও উপাচার্য পদে নিয়োগ পেতে তদবির করে থাকেন। এমন শিক্ষকরা উপাচার্য পদে নিয়োগ পেলে যাদের কাছে তদবির করে পদে এসেছেন, তাদের কথা না শুনে পারেন না। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ থেকে বিভিন্ন সুবিধাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি প্রাধান্য পায়। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষেত্রে উপাচার্য নিয়োগ করা অধিকতর কঠিন বিষয়। কারণ, এ সরকারের কোনো দল নেই। এরা কোনো বর্ণদলীয় শিক্ষককে উপাচার্য নিয়োগ দিলে তাদেরকে সেই দলের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করছে বলে অভিযোগ শুনতে হবে। আবার কোনো বর্ণদলীয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ত নন, এমন সুযোগ্য শিক্ষকও খুঁজে পাওয়া কঠিন। এ কারণে বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষা কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়লেও এখনো সরকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপাচার্য নিয়োগ করতে পারেনি।
তবে দলীয় হলেই যে সব শিক্ষক উপাচার্র্য হিসাবে মন্দ হবেন, এমনটা ভাবা ঠিক নয়। দলের মধ্যেও অনেক সৎ ও ভালো শিক্ষক থাকতে পারেন। কিন্তু তাদের উপাচার্য নিয়োগ দিলে তারা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে অধীনস্থ পদগুলোতে স্বদলীয় লোকজন নিয়োগ দিয়ে তাদের সহায়তা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করেন। বাস্তবতা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে উপাচার্যের উদ্দেশ্য ভালো থাকলেও তার চারপাশে ঘিরে থাকা স্তাবক শিক্ষক-কর্মকর্তারা তাকে প্রভাবিত করে অন্যায্য কাজে জড়িত হতে বাধ্য করেন। উপাচার্যের পক্ষে সংকটকালে কারও কথা না শুনে নিজে নিজে বিশ্ববিদ্যালয় চালানো কঠিন। এজন্য অনেক সময় উপাচার্য তার অধীনস্থদের কথা শোনেন। এমন অন্যায় কাজ হতে থাকলে উপাচার্যের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। তার বিরুদ্ধে অন্য যারা উপাচার্য হতে চান, তারা শিক্ষকদের উসকে দিয়ে আন্দোলনের সূচনা করেন। এমন আন্দোলন অনেক উপাচার্য পদ-পদবি ও সুযোগ সুবিধা বিতরণ করে স্তিমিত করতে পারেন। আবার অনেকে পারেন না। ফলে উপাচার্যবিরোধী আন্দোলন তীব্র হলে এক পর্যায়ে অনেক উপাচার্যকে ওপরের নির্দেশে পদত্যাগ করতে হয়। নতুন উপাচার্য এলে সাবেক উপাচার্যের সহযোগীরা আবারও নবাগত উপাচার্যের পরামর্শদাতা হয়ে তার চারপাশে ঘুর ঘুর করেন। শক্ত মেরুদণ্ডের যোগ্য উপাচার্য হলে এ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতিকারী শিক্ষকরা তাকে অন্যায় কাজে প্রভাবিত করতে পারেন না। বর্তমান সরকার হয়তো এমন ব্যক্তিত্বই খুঁজছেন। দলজড়িত শিক্ষকদের বাইরে এমন শিক্ষক খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিন। তবে সরকার বিদেশ থেকে বাংলাদেশি একাডেমিক এনে উপাচার্য পদে নিয়োগ দেওয়ার কথা ভেবে দেখতে পারে। সেক্ষেত্রেও ওই ধরনের উপাচার্যের পক্ষে স্থানীয় বাস্তবতা উপলব্ধি করে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করা কঠিন হবে। সে ক্ষেত্রেও উপাচার্যকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দলজড়িত শিক্ষকদের সহায়তা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করতে হবে।