আমাদের দৈনন্দিন জীবনে নিরাপত্তার ব্যত্যয় হয়েছে, এমন যে কোনো ঘটনায় প্রথমেই যে নামটি মনের অজান্তে উঠে আসে, তা হলো পুলিশ। সেই পুলিশ জনবান্ধব কিনা তা বিবেচ্য থাকে না। দুর্নীতি, অনিয়ম ও রাজনৈতিক পক্ষপাতের অভিযোগ সত্ত্বেও আমাদের দেশে পুলিশ এখনও ভরসার কাচের দেয়াল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের গণঅভ্যুত্থানের ফলে সরকার পতনের মধ্য দিয়ে সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে পুলিশ শব্দটি নিয়ে আতঙ্কের ধারণাটির পরিবর্তন ও এর বাস্তবধর্মী পুনর্গঠনের সুযোগ এসেছে। পুলিশকে জনবান্ধব করে গড়ে তোলাই হয়ে দাঁড়িয়েছে বড় চ্যালেঞ্জ। এই সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জকে বাস্তবসম্মত রূপে ফিরিয়ে আনতে হলে পুলিশ বাহিনীকে পুনর্গঠনের পাশাপাশি তাদের আচরণ ও মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তনে প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি চিন্তায় আনতে হবে।
আমরা জানি, জুলাই মাসে ন্যায্য অধিকার আদায়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণ, আবু সাঈদসহ ছয়জনের প্রাণহানি মানুষের ক্ষোভের আগুনে ঘি ঢেলেছিল। সেসব প্রাণহানির বিচারের বদলে পুলিশের এফআইআরে সাঈদের মৃত্যুর কারণ হিসেবে আন্দোলনকারীদের ইটপাটকেল ছোড়ার বর্ণনা ওই হত্যাকাণ্ডের ন্যায্যতা দেওয়ার নামান্তর। এর ফলে পরবর্তী দিনগুলোতে একদিকে যেমন পুলিশ নির্বিচারে গুলি করতে থাকে, অন্যদিকে জনতাও পুলিশকে প্রত্যক্ষ প্রতিপক্ষ বিবেচনা করে। ফলে দেশের বিভিন্ন স্থানে থানায় আক্রমণ হয়েছে; পুলিশও গুলি চালিয়েছে নির্দ্বিধায়।
পুলিশের প্রতি জনতার ক্ষোভের কারণ বিশ্লেষণে সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানাকে উদাহরণ হিসেবে নেওয়া যেতে পারে। ওই থানায় ৪ আগস্ট অন্তত ১৫ জন পুলিশ নিহত হয়েছিল জনতার হামলায়। এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হামলার ঘটনার সূত্রপাত স্থানীয় কলেজছাত্র ১৯ বছর বয়সী শিহাব আন্দোলনরত অবস্থায় পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়াকে কেন্দ্র করে। পুলিশ প্রথমে আত্মসমর্পণ করবে বললে পরিস্থিতি শান্ত হয়ে যায়। কিন্তু এর পরই আন্দোলনরত জনতার ওপর পুলিশ গুলিবর্ষণ করে। গুলিতে শিহাবসহ তিনজন নিহত হন। খোঁজ নিয়ে আরও জানা যায়, এনায়েতপুর পুলিশ আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের পরিবারের কাছ থেকে ১৬ জুলাইয়ের পর থেকে আন্দোলনের ছবি দেখিয়ে মামলা করার ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করত। এ ছাড়া সেখানকার সাধারণ মানুষকে বিভিন্নভাবে হয়রানি করত। ফলে মানুষ ফুঁসে উঠেছিল।
মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন পত্রপত্রিকা থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ১৬ জুলাই থেকে ১৩ আগস্ট পর্যন্ত সংঘর্ষ, নাশকতাসহ অন্যান্য ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৫৮৬ জন। এর মধ্যে পুলিশের সংখ্যা ৪১। নিহত পুলিশের প্রায় সবাই কনস্টেবল, এসআই ও ওসি পর্যায়ের। পুলিশের এসআই পর্যায়ের একজনের ভাষ্যমতে, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাদের বিপদের মুখে রেখে পালিয়েছেন; ঠিকমতো তথ্য দেননি। শুধু গুলি করার হুকুম দিয়েই চলে গেছেন। অবশ্য সব পুলিশের ক্ষেত্রেই এ কথা প্রযোজ্য নয়, বিশেষত যারা দলীয়ভাবে নিয়োগ পেয়েছেন তারা বেশি উৎসাহ দেখিয়ে জনতাকে গুলি করেছেন।
পুলিশের আইনে (পিআরবি) বলা আছে, এ ধরনের সিভিল ডিজঅবিডিয়েন্সের ক্ষেত্রে পুলিশ প্রথমে নন-লিথাল ওয়েপন ব্যবহার করবে। নিজের প্রাণ রক্ষার প্রয়োজন হলে পুলিশ লিথাল আর্মসও ব্যবহার করতে পারে। তাই এ বিষয়ে আইনগতভাবে তারা বিপদে পড়বেন, এমন সম্ভাবনা কম।
তবে অনেক ভিডিওতে দেখা গেছে, কাছে থেকে নিরস্ত্র মানুষকে সরাসরি গুলি করেছে পুলিশ। সঠিক তদন্তের মাধ্যমে তাদের খুঁজে বের করে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থার পাশাপাশি নিরীহ সদস্যদের পুরো উদ্যমে জনসেবায় ব্রতী হওয়ারও সুযোগ দেওয়া উচিত।
বিদায়ী সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে দলীয়করণের পাশাপাশি নিয়োগ, পদোন্নয়ন ও বদলি বাণিজ্য এমন পর্যায়ে গেছে, শোনা যায় একজন কনস্টেবলের নিয়োগের ক্ষেত্রেও ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা উৎকোচ দিতে হতো। শুধু তাই নয়, চাকরিপ্রার্থী ও তাঁর পরিবার সরকারদলীয় মনোভাবাপন্ন কিনা, তা নিশ্চিত করা হতো। এর মধ্যে যে যোগ্য প্রার্থীরা নিয়োগ পাননি তা নয়, তবে সংখ্যায় নিতান্তই কম। দলীয় পরিচয় এবং অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে নিয়োগকৃত যে পুলিশ সদস্যরা কাজ করেছেন, তার বিরূপ প্রভাবে দায়িত্ববোধ ধোঁয়াশা হয়ে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। সমাজে ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে জবাবদিহির ঘাটতি দেখা দিয়েছে। যে পরিবার ও সমাজে লক্ষাধিক টাকা ঘুষের বিনিময়ে পুলিশের চাকরিতে উৎসাহী করা হয়, সেই ব্যবস্থারও সংস্কার দরকার।